শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

দূষণে বিপন্ন সাভারের ছয় নদ-নদী

সাভার প্রতিনিধি

দূষণে বিপন্ন সাভারের ছয় নদ-নদী

সাভারে ট্যানারি বর্জ্যে দূষিত বংশী নদীর পানি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সাভারে ট্যানারি বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে ছয় নদ-নদীর পানি। হেমায়েতপুরের হরিণধরা চামড়া শিল্পনগরীর আশপাশের বংশী, ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদ দূষণের কবলে পড়ে ধুঁকছে। এর মধ্যে বংশী ও ধলেশ্বরীর পানি সবচেয়ে দূষিত। এ দুই নদীর সঙ্গে অন্য চার নদ-নদীর সংযোগ থাকায় সেগুলোও দূষণের শিকার হচ্ছে। এতে বিপন্ন হয়ে পড়েছে পরিবেশ।

এসব নদ-নদীর পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মাছ নেই বললেই চলে। জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্বও বিপন্ন। নদীকেন্দ্রিক স্বল্প আয়ের মানুষের জীবিকা নির্বাহ বিপর্যস্ত। দূষিত পানি ব্যবহারে মানুষ চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে আশপাশের বাসিন্দাদের। সাভার নদী পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এম সামসুল হক বলেন, তদারকি ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না করায় ছয়টি নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শিল্পনগরী স্থাপনের সময় পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল। হাজারীবাগের কাঠামো বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু নতুন কারখানা হলে উৎপাদন বাড়বে, এটিই স্বাভাবিক। ফলে বর্জ্য বেশি হচ্ছে। পরিশোধন করা যাচ্ছে না। ২০১৩ সালে কাজ শুরু হয়েছে, এখনো শেষ হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান জানান, ‘এ বিষয়ে সরকার শিগগিরই উদ্যোগ নেবে।’

পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, নদী রক্ষায় শিগগিরই প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, হাজারীবাগে ট্যানারিশিল্পে উৎপাদনের হিসাব অনুযায়ী সাভারে নকশা করে সিইটিপি স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সব কারখানাই তিন থেকে পাঁচ গুণ উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বর্জ্যও বেশি হচ্ছে। ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চামড়া শিল্পনগরীর পাশে বংশী ও অদূরে ধলেশ্বরীর আশপাশে ঘুরে দেখা গেছে, পোশাক কারখানা ও ট্যানারির বর্জ্যে পানির রং কালো ঘুটঘুটে। বংশী ও ধলেশ্বরীর দূষণের ৮৫ শতাংশই হচ্ছে ট্যানারির বর্জ্য। বাকি ১৫ শতাংশ অন্যান্য শিল্প বর্জ্য। বিসিক সূত্র থেকে জানা যায়, শিল্পনগরীতে ১৫৫টি কারখানা কার্যক্রম শুরু করেছে। কারখানায় তরল, কঠিন ও বায়বীয় তিন ধরনের বর্জ্য উৎপন্ন হয়। প্রতিদিন যে পরিমাণ তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয় সেগুলো পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই। এগুলো পরিশোধনের জন্য কমপক্ষে দুটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু একটি স্থাপন করা হয়েছে। তবে এটি সব সময় সচল থাকে না। এ ছাড়া নতুন নতুন কারখানা চালু হওয়ায় চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে বর্জ্যরে পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু একটি সিইটিপি দিয়ে সব বর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না। শিল্পনগরীর কঠিন বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে- পশুর খুর, নখ, কান, লেজ, শিং, হাড়, লোম, মাংসের ঝিল্লি ইত্যাদি। ডাম্পিং ইয়ার্ডে এগুলো ফেলা হয়। মাত্র ছয় একর জমিতে ডাম্পিং ইয়ার্ড করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। ফলে ডাম্পিং ইয়ার্ড উপচে কঠিন বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তায় ও নদীতে। পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। এগুলোতে থাকে নানা রাসায়নিক দ্রব্য। চামড়া পরিশোধন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের কিছু অংশ বায়বীয় পদার্থে রূপ নেয়। এগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টির পাশাপাশি বাতাস দূষিত করে। সালাউদ্দিন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, শিল্পনগরী থেকে মাটির নিচ দিয়ে শতাধিক প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। কৃষক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, নদীর পানি কোনো কিছুতেই ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি গরুও গোসল করানো যায় না। বয়োবৃদ্ধ কলিম শেখ জানান, পানি আগে এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে, নদীতলার বালি দেখা যেত। চিতল ও ফলি মাছ ধরতে নদীর এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত নৌকা নিয়ে ছুটতাম। আগে অগণিত জেলে সারা বছর মাছ ধরেও শেষ করতে পারত না। এখন তো নদীতে মাছও নেই, জেলেপাড়াও নেই।

সর্বশেষ খবর