শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মারা গেছেন বাদী-বিবাদী-আইনজীবী তবু নিষ্পত্তি হয়নি দেওয়ানি মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধের জের ধরে ১৯৫৮ সালে মুনসেফ আদালতে বাটোয়ারা মামলা (নম্বর ৩৯৭/৫৮) করেছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকার আসিরুননেসা। এরপর জেলা জজ আদালত হয়ে মামলা গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত। ১৯ বছর আগে মারা গেছেন বাদী আসিরুননেসা। মারা গেছেন প্রথম বিবাদী আবদুল জলিল। পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন ওই মামলার সঙ্গে জড়িত একাধিক আইনজীবী। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ৬২ বছর। আজও নিষ্পত্তি হয়নি মামলাটি। বর্তমানে মামলার বাদী আসিরুননেসার ৭০ বছর বয়সী মেয়ে হামিদা খাতুন মামলার শেষ দেখতে ঘুরছেন আদালতে। প্রথম বিবাদী মারা যাওয়ায় মামলা চালাচ্ছেন অন্যান্য বিবাদী।

এভাবে দিন যায়, মাস যায়, পেরিয়ে যায় যুগ, শেষ হয় না জমি-জমা সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলা। আইনজীবী যায়, আইনজীবী আসে, মামলার চূড়ান্ত ফল দেখে যেতে পারেন না বাদী কিংবা বিবাদী। মামলা চালাতে গিয়ে পথের ফকির হয়ে যায় অনেক পরিবার। গত মধ্য জুলাইয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের দেওয়া পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দেশের বিচারিক আদালতে প্রায় ৩২ লাখ ফৌজদারি ও ১৪ লাখের কাছাকাছি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন। উচ্চ ও অধস্তন আদালত মিলিয়ে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ১৫ হাজার ৫৩৩টি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন। হাই কোর্ট বিভাগে বিচারাধীন দেওয়ানি মামলার সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। শুধু ঢাকা জেলার বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে ১ লাখ ১৩ হাজার মামলা বিচারাধীন, যার বেশিরভাগই জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধসংক্রান্ত। এর মধ্যে জেলা জজ আদালতে বিচারাধীন প্রায় ৯৭ হাজার মামলা। এসব মামলার বড় অংশই কয়েক যুগের পুরনো।

যেমন চলছে আসিরুননেসার মামলা : সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকার আসিরুননেসা জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধের জেরে সংশ্লিষ্ট মুনসেফ আদালতে মামলা করেন ১৯৫৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর। বিচারিক আদালত বাদীর পক্ষে রায় দেয় ১৯৬২ সালের ২৩ আগস্ট। রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর জেলা জজ আদালতে আপিল করেন বিবাদী। শুনানি শেষে আদালত রায়টি আংশিক সংশোধন করে বাদীর পক্ষে রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ১৯৭০ সালে হাই কোর্টে আপিল করেন বিবাদী। ১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্ট অধস্তন আদালতের রায়টি আংশিক সংশোধন করে বাদীর পক্ষে রায় দেয়। একইসঙ্গে বাদী ডিক্রি পাওয়ার পর বিরোধীয় জমির মালিকানার অংশ নির্ধারণ করতে ১৯৯৪ সালে অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগ দেয়। ২০০০ সালের ২৪ এপ্রিল অ্যাডভোকেট কমিশনার সংশ্লিষ্ট অধস্তন আদালতে প্রতিবেদন দিলে তা মঞ্জুর করে বাদীর পক্ষে চূড়ান্ত ডিক্রি জারি হয় একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর। ওই প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি তুলে ২০০০ সালে বিবাদী জেলা জজ আদালতে আপিল করলে ২০০১ সালের ১৪ আগস্ট সেই আপিল খারিজ হয়ে যায়। এ আদেশের বিরুদ্ধে বিবাদীপক্ষ ২০০১ সালে হাই কোর্টে সিভিল রিভিশন আবেদন করে। ২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর এ মামলা নিয়ে বিচারিক আদালতের সব সিদ্ধান্ত বাতিল করে নতুন করে অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। হাই কোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ ২০১৬ সালে আপিল বিভাগে সিভিল লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করলে ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর লিভ টু আপিল গ্রহণ করে নিয়মিত আপিলের অনুমতি দেয় আপিল বিভাগ। বর্তমানে মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতে শুনানির পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, এ ধরনের মামলায় সাধারণত দুর্বলপক্ষই আদালতের শরণাপন্ন হয়। প্রভাবশালী পক্ষ সবসময় দখলে থাকে এবং তারা মামলা দীর্ঘায়িত করতে সবসময় সচেষ্ট থাকে। মামলার আরজি প্রস্তুত, শুনানির জন্য নোটিস জারি, বিবাদীর জবাব দাখিল ও গ্রহণে বিলম্ব, ঘন ঘন শুনানি মুলতবির আবেদন ও তা মঞ্জুর, বিচারক ও এজলাস স্বল্পতা, জুডিশিয়াল পলিসি ও দেওয়ানি আইনের সংস্কার না হওয়াসহ নানা কারণে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। আইনজীবীদের মতে, দেশে দেওয়ানি মামলার বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি যুগোপযোগী হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি মামলা পরিচালনার অনুপযোগী। দেওয়ানি মামলায় একটি বিধান রয়েছে যে, সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার আগে তিনবার সময় নেওয়া যায়। আবার সাক্ষ্য শুরু হলে ফের তিনবার সময় নেওয়া যায়। কিন্তু আইনে স্পষ্টভাবে বলা নেই যে, তিনবারের বেশি সময় নিলে কী হবে। এ ক্ষেত্রে বাদী তিনবারের বেশি সময় নিলে মামলা খারিজ কিংবা বিবাদী তিনবারের বেশি সময় নিলে বাদীর পক্ষে একতরফা ডিক্রি হবে; আর মামলা খারিজ বা একতরফা ডিক্রি হলে সংশ্লিষ্ট পক্ষ শুধু একবার আপিলের সুযোগ পাবেন- এমন বিধান থাকলে সুফল পাওয়া যেত।

সর্বশেষ খবর