শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বান্দরবানে অশান্তির আভাস!

১৩টি নৃ-গোষ্ঠীর অন্তঃকোন্দল চরমে

মানিক মুনতাসির, বান্দরবান থেকে

দেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কোনোটিরই সহাবস্থান এখন আর নেই। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই এসব নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ বান্দরবানে সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাস করে আসছিলেন। যা খাগড়াছড়ি কিংবা রাঙামাটিতে ছিল না কখনই। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে এসব জাতিসত্তার মধ্যে। তুচ্ছ ঘটনায় এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীকে আক্রমণ করছে। ঘটছে খুন, ধর্ষণ আর অপহরণের ঘটনা। আর এর জেরে এ অঞ্চলের তিন জেলাতেই আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। শুধু চলতি বছরই ৫২ জন নিরীহ মানুষ খুনের শিকার হয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তঃকোন্দল আর চাঁদাবাজির ঘটনায়। প্রতিদিন এখানে অন্তত এক কোটি টাকা চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হিসাবে বছরে এ অঞ্চলে অন্তত ৪০০ কোটি টাকার চাঁদা লেনদেন হয়। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চাঁদা না দিয়ে একটি ডাব কিংবা একটি কলার কাঁদিও বিক্রি করতে পারেন না সাধারণ মানুষ। রাস্তা সংস্কার কিংবা রাস্তা উন্নয়নের কাজেও চলে নীরব চাঁদাবাজি। অন্যথায় খুন, অপহরণের শিকার হতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের।

জানা গেছে, মারমা, মুরং, চাকমা, খাসিয়াসহ ১৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সবকটিই রয়েছে বান্দরবানে। যা রাঙামাটি বা খাগড়াছড়িতে নেই। এ জন্য এ জেলাটিকে বলা হয় সম্প্রীতির বান্দরবান।

১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির আগে থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়ি জেলাটিতে  বৈচিত্র্যর্পূণ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ বসবাসের কারণে পর্যটনশিল্প বিকশিত হতে থাকে। সেই বান্দরবানে এখন পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে চলছে পক্ষ-বিপক্ষের চরম উত্তেজনা। অথচ হোটেল মোটেল নির্মিত হলে স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে কর্মসংস্থান। প্রসারিত হবে পর্যটনের দুয়ার। বাড়বে দেশি-বিদেশি পর্যটন। যা এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থার আনবে ইতিবাচক পরিবর্তন। জানা গেছে, এখন চাঁদাবাজি অস্ত্র ও মাদক পাচারে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বান্দরবানের  দিকে বেশি ঝুঁকছে। অরক্ষিত সীমান্তে অবাধে ঢুকছে অস্ত্র। মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবার মতো যুব সমাজ ধ্বংসের মাদক।

পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব গ্রুপ বান্দরবানে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এতে করে বাড়ছে  খুনোখুনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা বাহিনী বান্দরবানে তাদের কার্যক্রম জোরদার করছে।

জানা গেছে, বান্দরবানে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশ বাঙালি। তবে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করার কারণে বান্দরবানকে বলা হতো ‘সম্প্রীতির বান্দরবান’। এখন বান্দরবানে রাজনৈতিক হত্যার পাশাপাশি চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। প্রতি মাসে এখানে অন্তত ৩৫ কোটি টাকার চাঁদাবাজি করছে এসব সশস্ত্র গ্রুপ। বলা হয়, বন্দুকের নল থেকে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে চাঁদা দিচ্ছে মানুষ। আবার প্রাণ ভয়ে কোনো বুক্তভোগী মুখও খুলছে না। সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে চাঁদা না দিয়ে সড়ক নির্মাণসহ কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া যায় না। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সাধারণ নাগরিক, যানবাহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মালিকানাধীন বিভিন্ন বাগান, বেসামরিক র্কমর্কতা ও র্কমচারী, ঠিকাদার সবার কাছ কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে। জানা গেছে পর্যটন শিল্পের বিকাশে বান্দরবানে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের কাজ অনুমতি দিয়েছে সরকার। নির্মিতব্য এ হোটেলটিতে প্রায় ২০০ জন অতিথি থাকতে পারবেন। কর্মসংস্থান হবে হাজারো মানুষের। সম্প্রতি হোটেলের নির্মাণ কাজ শুরু হলে পাহাড়ি গ্রুপগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়ে। পাহাড়ি গ্রুপগুলো যেসব অভিযোগ তুলে বিরোধিতা করছে তার সবই কাল্পনিক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন মূলত, পাহাড়ে উন্নয়ন হলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে বিধায় তারা পাঁচতারা হোটেল থেকে যে কোনো স্থাপনা নির্মাণে বাধা দিচ্ছে। এ জন্য তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে যেখানে সেখানে নতুন বসতি স্থাপনসহ সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু করেছে। জানা গেছে, বান্দরবানের সঙ্গে পাশের দেশের সীমান্তের মধ্যে ২৮ কিলোমিটার সীমান্ত অরক্ষিত আছ। গহিন অরণ্য আর যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় এখানে কোনো প্রহরা নেই। ফলে এ পথে অবাধে অস্ত্র বান্দরবানে ঢুকছে। পাহাড়, জঙ্গল, খাল হওয়ার কারণে দুর্গম এলাকায় টহল দেওয়া যায় না। রোহিঙ্গা সংকটের কারণেও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত থাকায় বান্দরবান অঞ্চলটি নিরাপত্তার দিক দিয়ে র্স্পশকাতর হয়ে উঠছে। এদিকে পুরো পার্বত্য অঞ্চলে চলছে নীরব চাঁদাবাজি। প্রতি বছর অন্তত ৪০০ কোটি টাকার চাঁদা তোলেন সশস্ত্র গ্রুপগুলো। এ অর্থে কেনা হয় অবৈধ অস্ত্র, মাদক। এ ছাড়া চাঁদার টাকায় প্রভাবশালীরা গড়ে তুলছেন বিভিন্ন রকম সম্পদ। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশেও তারা চাঁদার অর্থ পাচার করে তা দিয়ে গড়ে তুলছেন বিত্তবৈভব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর