সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায়ও জমজমাট পাহাড়ের অর্থনীতি

পর্যটন ঘিরে বাড়ছে কর্মসংস্থান

মানিক মুনতাসির, বান্দরবান থেকে

বিশ্বজুড়ে মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের আঘাতে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও এর তেমন প্রভাব নেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতিতে। এসব অঞ্চলে করোনার সংক্রমণও কম। প্রতিনিয়তই আসছেন দেশি-বিদেশি পর্যটক। তবে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কম। বেড়েছে কৃষি উৎপাদন। জুম চাষের বাইরে বিস্তার ঘটছে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির। সরকারের সহায়তায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ফল, শাক- সবজি, কাজু ও চীনা বাদামের চাষ। বাঁশ, বেত, কাঠের ব্যবসাও জমজমাট। হস্তশিল্প আর হ্যান্ডিক্রাফটের ব্যবসাও বেড়েছে কয়েক গুণ। আর পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় ছোট, বড় মোটেল, রেস্তোরাঁ, আবাসিক কটেজ গড়ে ওঠায় বাড়ছে বিকল্প কর্মসংস্থান। পরিসংখ্যান বলছে, দুর্গম স্থানে বসবাসকারী বেশিরভাগ পরিবারেরই বাহন এখন মোটরসাইকেল। এই মোটরসাইকেল ভাড়ায়ও চলছে এ অঞ্চলের বিভিন্ন রুটে। একই সঙ্গে পাহাড়ি মেয়েদের বোনা তাঁতের কাপড়, বিভিন্নরকম হ্যান্ডিক্রাফটের চাহিদা দেশজুড়েই। ফলে, এসব পণ্য এখন সারা দেশের সব এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়ছে। এ অঞ্চলের পেশাগত ও অর্থনৈতিক কাজে এসেছে নানা  বৈচিত্র্যও। আগে শুধু তাঁত বুনলেও গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাহারি হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিষদ। একই সঙ্গে পশুপালন ও গবাদি পশুর খামারও গড়ে উঠছে সরকারি সহায়তায়। সরেজমিন দেখা বান্দরবান, খাগড়াছড়ির বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বিস্তর এলাকাজুড়ে হচ্ছে কাজু বাদামের বাণিজ্যিক চাষ। কমলা চাষের আওতাও বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি হচ্ছে কলা এবং পেঁপের চাষ। এ দুটি ফলের চাহিদাও অনেক বেশি। উৎপাদন খরচ একেবারেই কম। এ ছাড়াও প্রাকৃতিকভাবে এসব ফলফলাদির উৎপাদন বেড়েছে। পর্যটকসহ মানুষের সামগ্রিক যাতায়াত বাড়ায় বেড়েছে বিক্রির পরিমাণ। আগে থেকে বুকিং না দিয়ে রাখলে কোনো মোটেল, কটেজ কিংবা আবাসিক হোটেলেও সিট পাওয়া কঠিন এ অঞ্চলে। পাহাড়ে দেখা স্বাভাবিক অর্থনীতির পাশাপাশি রয়েছে কালো অর্থনীতির একটা ব্যাপক প্রভাব। সীমান্ত পেরিয়ে আসছে বিভিন্ন রকমের মাদক। আসছে অবৈধ অস্ত্র। এসব মাদক ও অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশেই। ফলে এর কেনাবেচার ওপর কালো অর্থনীতির একটা ব্যাপক প্রভাব তৈরি হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী পাহাড়ি পরিবারগুলোও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে তুলছে মোটেল, কটেজসহ নানা ধরনের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। এর ফলে এসব অঞ্চলের মানুষের হাতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নগদ টাকার প্রবাহ। এই টাকার অপব্যবহারও হচ্ছে ব্যাপকভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিষদের তথ্যমতে, এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-মানের  উন্নয়ন ঘটছে প্রতিনিয়ত। যার ফলে এ অঞ্চলের অর্থনীতির ওপরও একটা বড় প্রভাব পড়ছে। পাহাড়বাসী মানুষের এখন আর পুষ্টির অভাব নেই। অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে মুরগি ও মাছের খামার। বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে বিভিন্নরকম ফল ফলাদির। ফলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্য অভ্যাসেও। এখন আর শুধু পাহাড়ি ফল খেয়ে দিন কাটাতে হয় না। আগের তুলনায় সহজ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থাও। ফলে মানুষের যাতায়াত খরচও কমেছে। অন্যদিকে খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও এসেছে নতুনত্ব। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেতে তৈরি হয়েছে প্রশস্ত রাস্তা। ফলে পাহাড়ের চূড়ায়ও পাওয়া যায় বোতলজাত পানি (মিনারেল ওয়াটার)। এমনকি কিছু কিছু মিনারেল ওয়াটার আছে ঝরনা থেকে সংগৃহীত। যা নীলগিরির রিসোর্টগুলোতে খুবই জনপ্রিয় এবং সহজপ্রাপ্য। শুধু তাই নয় বান্দরবানের চিমবুক এলাকার পাহাড় ও গহিন অরণ্যেও সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা দেখা গেল। যা দিয়ে রান্না করা হয় মজাদার খাবার। পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা শহরকেন্দ্রিক গড়ে ওঠে প্রচুর চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিষদের তথ্য মতে, প্রতিদিন এই তিন জেলায় অন্তত শত কোটি টাকার বেচা-বিক্রি হয়। এ ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের তৈজষপত্রের বাজার। পর্যটকরা এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র কেনেন হরদম। এমনকি এসব ক্ষেত্রে খুব একটা দরদামও করেন না। সরেজমিন দেখা গেছে, বান্দরবানের থানচির মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে একরের পর একরজুড়ে কাজু ও চীনা বাদামের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। একই রকম দৃশ্য চোখে পড়ে বলিপাড়ার দিকেও। এসব অঞ্চলে কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে ব্যাপকভাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর