শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আদালতের নির্দেশও মানছে না ফেসবুক গুগল ইউটিউব

২ হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপনে ভ্যাট ফাঁকি

রুহুল আমিন রাসেল

দেশের উচ্চ আদালতের নির্দেশও মানছে না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, গুগল ও ইউটিউব। এসব মাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠান বেসিস সূত্র বলছে- ফেসবুক, গুগল ও ইউটিউবে দেশীয় বিজ্ঞাপন প্রচারের হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন পাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। অথচ সরকার ভ্যাট বঞ্চিত হওয়ার তথ্য মিলছে। যদিও ফেসবুক, গুগল ও ইউটিউবের কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ফেসবুক, গুগল ও ইউটিউব কোনো প্রকার রাজস্ব দেয় না। বাংলাদেশে ব্যবসা করে ভ্যাট ও কর দিচ্ছে না। আবার তারা যে অর্থ নিচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেই। এর মধ্যে অর্থ পাচারও জড়িত। প্রচ- রকম আর্থিক অনিয়ম করছে ফেসবুক, গুগল ও ইউটিউব।

জানা গেছে, সিঙ্গাপুর-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় ফেসবুক-গুগল সিঙ্গাপুরে অফিস চালু করে বাংলাদেশে সেবা দিচ্ছে। সিঙ্গাপুরে কর পরিশোধের অজুহাতে তারা বাংলাদেশকে কর দিচ্ছে না। তবে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ফেসবুক মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি। যদি সিঙ্গাপুরিয়ান কোম্পানি হতো, তাহলে ওই যুক্তিটা মানা যেত। কিন্তু বাস্তবে ওই সব যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।

ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফেসবুক রেজিস্ট্রেশন নিয়েও দীর্ঘদিন ভ্যাট দিত না। সম্প্রতি তারা স্থানীয় এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছে। গুগল ও ইউটিউবের মতো অন্য যেসব অনলাইন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রদান করা হয়, সেখান থেকেও ভ্যাট আদায়ের তৎপরতা আছে। এ ব্যাপারে আদালত, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের নির্দেশনা রয়েছে। ফাঁকি ধরতে ব্যাপক তৎপর ভ্যাট গোয়েন্দা।

এর আগে ফেসবুক, ইউটিউব ও গুগলের বিজ্ঞাপনের আয় থেকে ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনাও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠিয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে থেকে সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহণকারীর কাছ থেকে মূসক (ভ্যাট) আদায় নিশ্চিত করতে হবে। মূল্য সংযোগ কর আইন-১৯৯১-এর ধারা ৩-এর উপধারা (৩)-এর দফা (ঘ) অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে থেকে সেবা (যেমন- রয়্যালটি, বিভিন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস, ফেসবুক, ইউটিউবসহ সব মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার ইত্যাদি) সরবরাহের ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে ১৫ শতাংশ হারে মূসক আদায়যোগ্য। এনবিআরের নির্দেশনায় বলা হয়, ফেসবুক ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস তথা এসব সেবার বিপরীতে পণ্যমূল্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো কোনো ব্যাংক এই খাত থেকে মূসক আদায় করছে না। এ অবস্থায় মাস্টার কার্ড, ভিসা কার্ড বা টিটি অথবা যে কোনো মাধ্যমে পেমেন্ট হলেই ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কেটে সরাসরি ট্রেজারিতে জমা করতে হবে। এদিকে ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর ফেসবুকের অনুমোদিত এজেন্ট এইচটিটিপুল বাংলাদেশ লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৯৩ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে মামলা করেছে। সংস্থাটি জানতে পারে, নিবন্ধিত স্থানে প্রতিষ্ঠানটির কোনো কার্যক্রম বা অস্তিত্ব নেই। ভ্যাট আইন অনুসারে অফিস পরিবর্তন করতে হলে ভ্যাট অফিসকে জানাতে হবে। তাদের এই পরিবর্তনের কোনো নোটিস দেওয়া হয়নি। এই এজেন্ট তিন মাস আগে নিবন্ধন নিলেও কোনো রিটার্ন দাখিল করেনি। ভ্যাট আইন অনুসারে প্রতি মাসে রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। এইচটিটিপুল প্রতি মাসে রিটার্ন দাখিল না করায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কর্তন করা ভ্যাট সরকারি কোষাগারেও জমা হয়নি। এভাবে সরকারের ৯৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা ফাঁকি দেয় ফেসবুক। ওই টাকা সরকারের কোষাগারে জমা না হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হওয়ায়, মাসিক রিটার্ন দাখিল না করায় এবং অনুমোদন ব্যতিরেকে অস্তিত্বহীন হওয়ায় মামলাটি দায়ের করে ভ্যাট গোয়েন্দা। সংস্থা মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট অফিসে পাঠায়।  ফেসবুক আরও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখছে ভ্যাট গোয়েন্দা। সবশেষ গত ৮ নভেম্বর গুগল, ফেসবুকসহ অন্য ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব ধরনের কর, ভ্যাট এবং অন্যান্য রাজস্ব আদায়ে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছে আদালত।

 এ সংক্রান্ত রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ঘোষিত রায়ের পাঁচ দফা নির্দেশনায় বলা হয়- এক. অনতিবিলম্বে সব ইন্টারনেট, যেমন- গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, অ্যামাজন কোম্পানিগুলোকে পরিশোধিত (বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো) অর্থ থেকে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব ধরনের কর, ভ্যাট এবং অন্যান্য রাজস্ব আদায় করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিটিআরসিসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলোকে এ আদেশ প্রদান করা হয়েছে। দুই. ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশ থেকে বিগত পাঁচ বছরে পরিশোধিত অর্থের বিপরীতে আনুপাতিক হারে বকেয়া রাজস্ব আদায় করতে হবে। তিন. উক্ত রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর হলফনামা আকারে অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবে। চার. এই রায়টি একটি চলমান আদেশ বা কন্টিনিউয়াস ম্যানডামাস হিসেবে বলবৎ থাকবে। পাঁচ. এই রায় বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটলে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক যে কোনো সময় আদালতে আবেদন দাখিল করে প্রতিকার চাইতে পারবেন।

সর্বশেষ খবর