শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সমন্বয় নিয়ে চ্যালেঞ্জে দুই সিটি

শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

রাজধানীর নর্দা, মাদানী এভিনিউ, গুলশান-২ পর্যন্ত ৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। রাস্তা খুঁড়ে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) সংযোগ তার বসানো হচ্ছে। গত বছর এই রাস্তার আরেক পাশে খুঁড়ে পয়ঃনিষ্কাশন লাইন বসিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এভাবে এক সড়কে বারবার খোঁড়াখুঁড়িতে বাড়ছে অর্থের অপচয়, দীর্ঘায়িত হচ্ছে জনভোগান্তি, কমছে রাস্তার মেয়াদ, বাড়ছে যানজট। বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়িতে ধুলোর শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। এই সড়ক ছাড়াও আফতাবনগর থেকে ইউলুপ পর্যন্ত সড়কে ডেসকোর কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়া হয়েছে। সাউথ পয়েন্ট স্কুল, ওয়াপদা রোডে ডিপিডিসির উন্নয়ন কাজের জন্য সড়ক খোঁড়া হয়েছে। চলতি মাসের ৩০ তারিখে ডিপিডিসির কাজ শেষ হলে রাস্তা কার্পেটিংয়ে কাজ শুরু করবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। উত্তরার অধিকাংশ সড়কে রয়েছে খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষতচিহ্ন। ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ৫ নম্বর রোডের মাথায় দুই-তিন মাস আগে একবার খুঁড়তে দেখেছি। এরপর ইটের খোয়া ফেলে সমান করে রেখে যায়। মাসখানেক আগে আবার কারা যেন খুঁড়ে পাকা না করে রেখে গেছে।

৫৬ সেবা সংস্থার সমন্বয় না থাকায় বছরজুড়ে চলতে থাকে রাজধানীতে খোঁড়াখুঁড়ি। এক সংস্থা রাস্তা খুঁড়ে যাওয়ার মাস পার না হতেই খুঁড়তে শুরু করে আরেক সংস্থা। এতে অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি বছরজুড়ে মানুষের ভোগান্তি লেগেই থাকে। এই পরিস্থিতিতে রাজধানীর উন্নয়ন ও সেবার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের উদ্যোগ নেয় দুই সিটি। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়ের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সরকারি ২১টি সংস্থা ও ৫ প্রকল্পকে গত ৫ অক্টোবর চিঠি দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় না করে বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে ঢাকা শহর অপরিকল্পিত নগরীতে পরিণত হচ্ছে। জলাশয় ভরাট করে আবাসিক ভবনের অনুমতি প্রদান করায় দুর্যোগ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, খাল বেদখল হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, সুপেয় পানি, সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এবং উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক রাস্তা কর্তনের ফলে সর্বসাধারণ ও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ডিএসসিসি এলাকায় এই অর্থবছরে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পের বিবরণ ৩১ অক্টোবর ২০২০ তারিখের মধ্যে ডিএসসিসিকে অবহিত করে মতামত গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়। তবে মাত্র ছয়টি সংস্থা ও প্রকল্প ডিএসসিসির চিঠির জবাব দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এর বাইরে ইন্টারনেট নিয়ে কাজ করা দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিএসসিসিকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। এদিকে গত বছর ডিসেম্বরে সব সেবা সংস্থাকে চিঠি দিয়েছিল ডিএনসিসি। কোন সংস্থা কখন, কোন রাস্তায় উন্নয়ন কাজের জন্য খুঁড়তে চায় তা বছরের শুরুতে সিটি করপোরেশনকে জানাতে বলা হয় চিঠিতে। কোনো সেবা সংস্থাই চিঠির জবাব দেয়নি।

ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সেবা সংস্থার সমন্বয়হীনতায় এক রাস্তা বারবার  খোঁড়াখুঁড়িতে অপচয় ও দুর্ভোগ বাড়ে। এই অপচয় ও ভোগান্তি কমাতে ডিএনসিসি এলাকায় কোন সেবা সংস্থা কোথায় কাজ করতে চায় তা জানাতে বলেছি। নয়তো ডিএনসিসি রাস্তা নির্মাণ করার পাঁচ বছর পর্যন্ত কাউকে রাস্তা খুঁড়তে দেব না। সব সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করাই চ্যালেঞ্জ। ডিএনসিসির সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়–য়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ডিএনসিসির পক্ষ থেকে সব সেবা সংস্থাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, তারা বছরজুড়ে ডিএনসিসি এলাকার কোন রাস্তায় উন্নয়ন কাজ করতে চায় তা বছরের শুরুতে জানাতে। তাহলে সমন্বয় করে আমাদের উন্নয়ন কাজ করব। নয়তো আমরা রাস্তা তৈরি করে যাওয়ার পরে অন্য সংস্থা খুঁড়লে অর্থের অপচয় এবং জনভোগান্তি দুটিই বাড়ে। কিন্তু কোনো সেবা সংস্থা ডিএনসিসিকে কোনো উত্তর দেয়নি। তারা তাদের উন্নয়ন কাজের পরিকল্পনাও জানায়নি। সমন্বয় সভার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এ বছর করোনা মহামারীর কারণে সমন্বয় সভা করা সম্ভব হয়নি। এদিকে দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছাড়া জনভোগান্তি হ্রাস ও পরিকল্পিত নগরী গড়া সম্ভব নয়। আমরা মেয়র মহোদয়ের নির্দেশে সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়েছি। এই অর্থবছরে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পের বিবরণ চেয়েছিলাম। কেউ চিঠির জবাব দিয়েছেন, কেউ দেননি। তিনি আরও বলেন, আমরা আবার সংস্থাগুলোকে তাগিদ দেব। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনকেও লিখব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে উন্নত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে উন্নত ঢাকা হিসেবে গড়তে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ এর তৃতীয় তফসিলের ১৬ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘Integrated City Master Plan for Dhaka’ তৈরির কাজ চলছে। সমন্বিত মহাপরিকল্পনাটি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের মতামত গ্রহণপূর্বক সমন্বয় করেই বাস্তবায়ন করতে হবে। নগরবিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে নগর সরকারের মাধ্যমে এ রকম মেগা সিটি পরিচালিত হয়। এক ছাতার নিচে থাকায় সেবা সংস্থার সমন্বয়ে কোনো সমস্যা হয় না। সেখানে এক রাস্তা বারবার খোঁড়ার প্রয়োজন পড়ে না। বিভিন্ন সংস্থার প্রকল্প বিভিন্ন সময় পাস হয়। অর্থ বরাদ্দ হলে তারা তখনই কাজ শুরু করে। সমন্বয় করে প্রকল্প না নেওয়ায় এক রাস্তা বারবার খুঁড়তে হয়। ইউটিলিটি ডাক্ট কিংবা হাব নির্মাণ করে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। রাস্তা তৈরির সময় ইউটিলিটি ডাক্ট নির্মাণ করলে তারা ওই ডাক্টের মাধ্যমে যে কোনো সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। এতে বারবার রাস্তা খোঁড়ার প্রয়োজন পড়বে না।

জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব যাচ্ছে দুই সিটির কাছে : রাজধানীতে নাগরিক ভোগান্তির অন্যতম একটি বিষয় জলজট ও জলাবদ্ধতা। এত দিন এই সমস্যার জন্য ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে আসছিল। জানা গেছে, দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর এবার রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব পাকাপাকিভাবে যাচ্ছে দুই সিটি করপোরেশনের হাতে। এ জন্য নতুন বছরের শুরুতেই ওয়াসার কাছ থেকে রাজধানীর খাল, বক্সকালভার্ট ও  ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে দুই সিটি করপোরেশনের হাতে। দুই মেয়রের আগ্রহের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের মধ্যস্থতায় গত ২৬ নভেম্বর খাল, বক্সকালভার্ট, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ওয়াসার কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে ১৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি চলতি মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি সভার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হবে দুই সিটি করপোরেশনকে। চলমান প্রকল্পগুলো ডিসেম্বর পর্যন্ত ওয়াসা করবে। জানুয়ারি থেকে সেগুলো সিটি করপোরেশনের কাছে চলে যাবে। এটা হলে জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন সব উদ্যোগ নিতে পারবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ খবর