বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্যা ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগের বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক

জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের বড় সাক্ষী হয়ে রইল ২০২০ সাল। দীর্ঘমেয়াদি বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ল-ভ- করে দিয়ে গেছে দুর্বার গতিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগোতে থাকা বাংলাদেশের অবকাঠামো। তছনছ করে গেছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিধ্বস্ত হয়েছে রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, ঘর-বাড়ি, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও বন্যার ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই চলতি বছর করোনা মহামারী, দীর্ঘমেয়াদি বন্যা ও প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় পথে বসিয়েছে লাখ লাখ পরিবারকে। বাড়িয়ে দিয়েছে দারিদ্র্য। দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। ২৬ জুন থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে তিন মাসের বন্যা ও ২০ মে মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরোক্ষভাবে এই ক্ষতির দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সারা দেশের মানুষকে। ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখনো বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ত্রাণ দিতে গিয়ে চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশকে আবারও চাল আমদানি করতে হচ্ছে। সরকারের হিসাবে এ বছরের বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদহানি হয়েছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বন্যা পরবর্তী অর্থনৈতিক ক্ষতি লাখ কোটির বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে ২১টি জেলায়। এতে ১০ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫৮ দশমিক ১২ কিলোমিটার বাঁধ। ১৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৮৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৬৫টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও কমিউনিটি ক্লিনিক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুটি ব্রিজ সম্পূর্ণ এবং ১১০টি ব্রিজ ও কালভার্ট আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার পাকা সড়ক সম্পূর্ণ ও ২৭০ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার পাকা সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৭৬ কিলোমিটার ইটের সড়ক ও ১৯ দশমিক ৯৮ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক সম্পূর্ণ এবং ৯১ দশমিক ৯০ কিলোমিটার ইটের সড়ক ও ৬৪৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০ হাজার ১০৩ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন সম্পূর্ণ ও ৫২ হাজার ৯৭২ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইনের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ৩৪৪টি গভীর নলকূপ ও ৬৭২টি অগভীর নলকূপ সম্পূর্ণ এবং ২ হাজার ৩১৯টি গভীর নলকূপ ও ১ হাজার ৯২৩টি অগভীর নলকূপ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে ১০ হাজার ২৯৬টি ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ২১৭টি। ১৫৪টি পাকা ঘর, ৬ হাজার ৮৬৭টি আধাপাকা ঘর ও ৮৬ হাজার ১০১টি কাঁচা ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৫৪৭টি পাকা, ৬৯ হাজার ৩৬৩টি আধাপাকা ও ২ লাখ ৩০ হাজার ১২৩টি কাঁচা ঘর। ৩ লাখ ২৪ হাজার ৮৮২টি হাঁস-মুরগি, ৩০০ গরু-মহিষ, ৫১৭টি ভেড়া ও ছাগল মারা গেছে বা ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় দেড় লাখ হেক্টর ফসলি জমি ও বীজতলা। এ ছাড়া ভেসে গেছে পুকুর ও খামারের মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার হেক্টরের বেশি বনাঞ্চল ও নার্সারি। অপরদিকে টানা সাড়ে তিন মাসের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩টি জেলা। এর মধ্যে ৫৫০টি ইউনিয়ন ও পৌর ওয়ার্ডের অবস্থা শোচনীয়। ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৯৩ জন মানুষ সরাসরি ক্ষতির শিকার হয়েছে এ বন্যায়। ২৬ জুন থেকে শুরু হওয়া বন্যা কয়েক দফা বিরতি দিয়ে শেষ হয় ১০ অক্টোবর। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সড়ক-ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৮২২টি ঘর। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৮৫টি পাকা, ২ হাজার ৩টি আধাপাকা ও ১ লাখ ৮১ হাজার ১৫৪টি কাঁচা ঘর। ১৭ দশমিক ১৪ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন সম্পূর্ণ ও ৪৪৬ দশমিক ৪০ কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৪ হাজার ৮০০ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক। ৩৯৯ দশমিক ৪০ কিলোমিটার পাকা সড়ক সম্পূর্ণ ও ৩ হাজার ৫৫৩ কিলোমিটার পাকা সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ হাজার ৯৪৯টি ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১২৮টি। ৫০৫ দশমিক ৭৬ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩ হাজার ৩০৬টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০০টি। ৮৩ হাজার ৪৫৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদী ভাঙনে হারিয়ে গেছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবন। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১২টি উচ্চবিদ্যালয়, একটি কলেজ ও নয়টি মাদ্রাসা। ৭২ হাজার ১৮৮টি গভীর ও অগভীর নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণ ক্ষতির মুখে পড়েছে ৫ হাজার ৩৩টি। এ ছাড়া দেড় লক্ষাধিক স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, বিপুল সংখ্যক জলাধার, মাছের খামার, শস্যখেত, বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলে বন্যায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৯৭২ কোটি ৭৪ লাখ ৬২ হাজার টাকার। ২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলের ১০ লাখ ৭০ হাজার লোক। অনেক প্রাণহানি ছাড়াও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এখনো সেই অবকাঠামো সংস্কার শেষ হয়নি। এর পরেই ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা ল-ভ- করে দিয়ে গেছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে। এখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অনেক এলাকা। এলজিইডি সূত্র জানায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব খাতের ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বরাদ্দ রয়েছে। এ ছাড়া অবকাঠামো পুনর্বাসনে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-ব্রিজ-কালভার্ট সংস্কারের মাধ্যমে পল্লীসড়ক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা সংরক্ষণে সরকার ৫ হাজার ৯০৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ‘ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পল্লী সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসন’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ বছর শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। এ ছাড়া কৃষির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকার পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যায় একই সড়ক বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংস্কার শেষ হতে না হতেই আবার ভাঙছে। এক বছরে ভাঙলে পুনর্বাসন করতে কয়েক বছর লেগে যাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে সরকারকে। টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সড়কের নকশা বদলে বিকল্প পথে (যে স্থানে পানি ওঠে না) নতুন সড়ক করার পাশাপাশি টেকসই উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে সড়কের স্থায়িত্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে।

সর্বশেষ খবর