সোমবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ বালু উত্তোলন

ভাঙনের কবলে গ্রাম

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ বালু উত্তোলন

শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র ও বানার নদীতে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। বালু দস্যুতার মহোৎসব চলছে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ জেলার সীমান্ত এলাকায়। তিন জেলার সীমান্ত দিয়ে শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র ও বানার নদী বয়ে গেছে। এই সুযোগে একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারিভাবে কোনো অনুমোদন না থাকলেও শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র ও বানার নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন চলছেই।

স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চিহ্নিত চক্র অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী। এতে গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের সীমান্ত এলাকার শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র ও বানার নদী এবং নদীতীরবর্তী হাট-বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদরাসা, আঞ্চলিক সড়ক ও নদীর ওপর নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ সেতু হুমকির মুখে পড়েছে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। অবৈধ বালু উত্তোলন করে গাজীপুরের শ্রীপুর ও কাপাসিয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে বালুর বড় বড় গদি করায় হুমকিতে পড়েছে সড়ক। কাপাসিয়ার উত্তরে ময়মনসিংহের সীমান্তঘেঁষা টোকেরবাজার থেকে সোহাগপুর বাজার, কুড়িয়াদী, ঝাউয়াদী, সিংহশ্রী হয়ে শ্রীপুর-মাওনা যাতায়াতের সড়ক ও শ্রীপুরের গোসিংগা, লতিফপুর, নারায়ণপুর হয়ে কাপাসিয়া সড়ক এখন হুমকিতে। সড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে ফাটল ধরেছে। এমনকি নদী তীরবর্তী সড়কের কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে বালুদস্যুদের কর্মকান্ড যেন কেউ দেখেও দেখছে না। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। জায়গায় জায়গায় ভূমিধসের ঘটনাও ঘটছে। গত ১১ ডিসেম্বর কাপাসিয়ার দস্যুনারায়ণপুর এলাকায় শ্রীপুর-কাপাসিয়া আঞ্চলিক সড়কের একাংশ অন্তত ১৫ ফুট নিচে দেবে যায়। এ ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী মানুষজন।

নদী ভাঙনে কাপাসিয়া, শ্রীপুর ও ময়মনসিংহের গফরগাঁও, পাগলা, কিশোরগঞ্জের মঠখোলা, ড্রেনের ঘাটের লক্ষাধিক নিরীহ মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটছে। অবৈধ বালু উত্তোলনে প্রশাসন কোনো ধরনের উদ্যোগই নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই অবৈধ বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের। নদীতীরবর্তী মসজিদ, মাদরাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, আঞ্চলিক সড়ক এখন হুমকির মুখে।

প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় বরাবরই পার পেয়ে যাচ্ছেন এসব অবৈধ বালু ব্যবসায়ী। অবৈধভাবে অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে ইতিপূর্বে একের পর এক ভূমি দেবে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গত ১৫ বছরে বিভিন্ন সময় শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় এলাকায় বড় ধরনের কয়েকটি ভূমিধসের ঘটনাও ঘটেছে। ভূমিধসগুলো এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, ৩০-৩৫ ফুট গভীর অতলে দেবে যায় বসতবাড়ি। নদীতে গোসল করতে গিয়ে ড্রেজারের নিচে পড়ে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। গত ডিসেম্বরে কাপাসিয়ার সিংহশ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সিংহশ্রী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক সোহাগপুর এলাকার চেরাগ আলী মাস্টার নদীতে গোসল করতে গিয়ে বালুর ড্রেজারে ধাক্কা লেগে মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। সরেজমিন দেখা যায়, কাপাসিয়ার সিংহশ্রী ইউনিয়নের ঝাউয়াদী, কুড়িয়াদী, পাতলাশী, সোহাগপুর বাজার এলাকায় নদীতে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন চলছে। নদীর তীরে ড্রেজার দিয়ে এমনভাবে বালু তোলা হচ্ছে যে দূর থেকে কারও নজরেই আসে না। এমনকি ওই এলাকায় পাহারাদারও রয়েছে যাতে প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ ড্রেজার পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে। ওই এলাকায় কোনো অপরিচিত মানুষকে দেখলেই নানাভাবে হয়রানি করছে বালু সন্ত্রাসীরা। অবৈধ বালু উত্তোলনে গফরগাঁও পাগলার পাতলাশী বাজার, চরের বাজার, ত্রিমোহনী বাজার, বকুলতলা বাজার, বারইহাটি বাজার, চাঁনপুরের বাজার, ডাকবাংলো বাজার, টাঙ্গাব বাজার, বামনখালী বাজার, পাতলাশী পশ্চিমপাড়া নায়েব আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাতলাশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুরচাই বকুলতলা উচ্চ বিদ্যালয়, চাকুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বারইহাটি ফাজিল মাদরাসা, বারইহাটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাকবাংলো মহিলা দাখিল মাদরাসা. টাঙ্গাব ফাজিল মাদরাসা, টাঙ্গাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কবুলতলা কেন্দ্রীয় ঈদগাহ, কাপাসিয়ার ফরেস্ট অফিস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পীরের বাজার মসজিদ, পীরের বাজার, সোহাগপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সোহাগপুর আলিম মাদরাসা, সোহাগপুর বাজার, সোহাগপুর মসজিদ, উলুসারা বাজার, উলুসারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উলুসারা আবদুল কাদের উচ্চ বিদ্যালয়, পুবাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুবাইল বাজার, টোক নরেন্দ্র চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, টোক পুলিশ ফাঁড়ি, গুরুত্বপূর্ণ টোকবাজার, টোকবাজার জামে মসজিদ, টোক ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স, কুড়িয়াদি মাদরাসাসহ অংসখ্য প্রতিষ্ঠান এখন হুমকির মুখে।

গফরগাঁওয়ের এক ব্যবসায়ী বলেন, বালু উত্তোলনকারীরা এতটাই ভয়ংকর যে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পায় না। আমরা সাধারণ মানুষ এসব বালু ব্যবসায়ীর অত্যাচারে এলাকায় বসবাস করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোসা. ইসমত আরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শীতলক্ষ্যা ও বানার নদীর কাপাসিয়া অংশে চুরি করে বালু উত্তোলনের বিষয়টি জানতে পেরে কয়েকবার অভিযান চালানো হয়েছে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র, বানার নদীতে বালু উত্তোলনের কোনো ইজারা নেই। তারপরও কিছু লোক অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে বলে জানতে পারি। তবে এসব কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে আমাদের।

সর্বশেষ খবর