মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ঐতিহ্য ফিরে পেল ঢাকাই মসলিন

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

ঐতিহ্য ফিরে পেল ঢাকাই মসলিন

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকের নেতৃত্বে ১৭০ বছর পর ঐতিহ্য ফিরে পেল ঢাকাই মসলিন। ঢাকাই মসলিন এখন বাংলাদেশেরই। গবেষকদের দীর্ঘ ছয় বছরের প্রচেষ্টায় মিলেছে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি। ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। শিগগিরই বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে মসলিনের নতুন যুগে। মসলিন ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এক ধরনের মিহি সুতিবস্ত্র। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে উৎপন্ন অতি চিকন সুতা দিয়ে তৈরি হতো মসলিন। দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া এ মসলিন ১৭০ বছর পর আবার ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন একদল গবেষক। দীর্ঘ ছয় বছরের চেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সক্ষম হয়েছেন তারা। ১৮৫০ সালে লন্ডনে প্রদর্শনের ১৭০ বছর পর বাংলাদেশে বোনা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মসলিন শাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকায় মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও পুনরুদ্ধার নামের প্রকল্পটি ২০১৪ সালে হাতে নেওয়া হয়েছিল। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পরে গবেষণা কাজের স্বার্থে কমিটিতে যুক্ত করা হয় আরও সাতজন সদস্য। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনকে। ছয় বছরের প্রচেষ্টায় ধরা দেওয়া সাফল্যের গল্প জানিয়েছেন প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. মো. মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, ‘বই থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মসলিন কাপড় বোনার জন্য “ফুটি কার্পাস”-এর কথা জানতে পারি। পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে এ গাছ চাষ হতো। মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকোয়েন্স ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই হয়তো কোনো তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের হাতে কোনো মসলিন কাপড়, ফুটি কার্পাস কোনোটাই ছিল না। ফুটি কার্পাস তুলা সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়েছি। এর মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাস দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে একজন ছাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানায়, কাপাসিয়ায় এ তুলার চাষ হতো। গাছের খোঁজে সে এলাকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় চিঠি পাঠানো হয়, মাইকিং করা হয়। পরে সেখানে নয়টি তুলাগাছ পাই। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৮ প্রজাতির তুলাগাছের সন্ধান পাই। সংগ্রহ করা এসব গাছ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠে চাষ শুরু করি। স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন খুঁজতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয় আট টুকরা কাপড়। সেগুলোর কোনোটি মসলিন ছিল না। পরে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যাই। কিন্তু সেখানেও পাওয়া যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যাওয়া হয়।

সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়।’ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনজুর হোসেন বলেন, ‘কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার আঁশ বেশি শক্ত, সাদা ধবধবে। এটা মসলিনের সেই সুতার কাছাকাছি যেতে পারে এমন ধারণা ছিল। তারপর লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ আর সেই তুলার ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হলো, কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার জাতটা ফুটি কার্পাস। মসলিন তৈরি করার জন্য সাধারণত ৩০০ থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা সহজ নয়। এ সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে।

চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় পাওয়া যায়। কিন্তু তারা মোটা সুতা কাটেন, যাতে কাউন্টের মাপ আসে না। পরে তাদের ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখান থেকে ছয়জনকে বাছাই করা হয়। বাছাই করতেই প্রায় দুই বছর লেগে যায়। অবশেষে সুতা নিয়ে তাঁতির দুয়ারে হাজির হলাম। নারায়ণগঞ্জে দুজন তাঁতির খোঁজ পেলাম। কিন্তু এত মিহি সুতা দিয়ে কেউ বানাতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে তাদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু কষ্টে তারা বুনন পদ্ধতি রপ্ত করেন। অবশেষে ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়, যার একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেওয়া হয়েছে।’ প্রকল্পের ব্যয় সম্পর্কে অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। বরাদ্দের ৩০ শতাংশ খরচ হয়েছে। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ টাকা সরকারের কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আরেকজন গবেষক অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রায় ১০ মাস আগে মসলিনের পাঁচটি নমুনা দিয়ে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়। এতে মসলিনের উৎপত্তি, বুনন পদ্ধতি ও সুতা বাংলাদেশের বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাঁরা আশা করছেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিগগিরই দেশে মসলিনের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে। এতে বাংলাদেশ পা দেবে মসলিনের নতুন অধ্যায়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর