মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি খাতে অগ্রাধিকার

সার বীজে ভর্তুকি, যান্ত্রিকীকরণসহ প্রশিক্ষণের আওতা বাড়বে কৃষকদের

মানিক মুনতাসির

খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি খাতে অগ্রাধিকার

করোনা মহামারীতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পরই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিকে তৃতীয় অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কৃষি খাতকে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সার, বীজে ভর্তুকি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের পাশাপাশি এসব উপকরণ ব্যবহার ও আধুনিক কৃষি সম্পর্কে সম্যক ধারণা বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বছরজুড়েই। এর জন্য পৃথকভাবে বরাদ্দ রাখা হবে জাতীয় বাজেটে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বাজেট মনিটরিং কমিটির সমন্বয় সভায় এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নতুন কার্যক্রম শুরু করেছে জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বায়ার ক্রপসায়েন্স লিমিটেড। বৈশি^ক কর্মসূচির আওতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় দেশের প্রায় ১৫ হাজার প্রান্তিক কৃষককে পর্যায়ক্রমে আধুনিক কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে সংস্থাটি।

সূত্র জানায়, প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের কৃষি খাতে রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বীজ বপন থেকে ফসল মাড়াই এমনকি সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর ফলে ১৯৭১ সালের তুলনায় কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে ৩০ গুণ। আর দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা দারিদ্র্যের দেশ থেকে বাংলাদেশ হয়েছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে দেশের ৮০-৯০ ভাগ কৃষকই প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি সরঞ্জাম ব্যবহার করছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষে কৃষি গবেষণাতেও ব্যাপক উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। যার ফলে প্রতিনিয়তই উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনে এগিয়ে যাচ্ছে  বাংলাদেশ। গত এক দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশের কৃষিতে প্রায় ৫০ ধরনের নতুন জাতের ধান যুক্ত হয়েছে। একইভাবে যুক্ত হয়েছে নতুন জাতের ভুট্টা, গম, সরিষা ও বিভিন্ন ধরনের সবজি। সব ধরনের শস্যখেতে বালাইনাশক কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে যা মূলত প্রযুক্তিরই আশীর্বাদ। এর ফলে উচ্চ ফলনশীল জাতের শস্য দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ পেছনে ফেলেছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিলকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, এক দশকে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান-চাল ও মাছ উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনেও চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম স্থান অর্জন করেছে। একইভাবে আলু উৎপাদনেও এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষস্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ।  স্বাধীনতার পর গরু-মহিষ দিয়ে হালচাষ করে ফসল ফলানো আর হাতে নিড়ানি দিয়ে আগাছা দমন করাই ছিল খাতের একমাত্র ভরসা। এখন প্রায় ৭৫ ভাগ জমিতেই পাওয়ার টিলার ব্যবহার করা হয়। একই সঙ্গে শ্যালো মেশিন কিংবা গভীর নলকূপের সাহায্যে সেচ দেওয়া হয়। বীজ বপন, চারা রোপণ, কাটা, মাড়াই, আগাছা দমন এবং সংরক্ষণ প্রত্যেকটি ধাপেই উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। আসছে বাজেটে এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে কৃষি খাত উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেভাবে নেতিবাচক পর্যায়ে চলে গেছে সেখানে বাংলাদেশ ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে কৃষির বাম্পার ফলন। এটা কৃষির আধুনিকীকরণের জন্য সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করে সরকার। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, কৃষি ব্যবস্থাকে শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ করতে চায় সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা ৪০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। আগামী বাজেটে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। আমাদের জনসংখ্যার ভিত্তিতে জমির পরিমাণ খুবই কম। শিল্প খাতের প্রসারের কারণে কৃষি জমির পরিমাণও কমছে। ভবিষ্যতে খাদ্য চাহিদা মেটাতে উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবন। যার জন্য প্রয়োজন বেশি গবেষণা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, সারা দেশে বর্তমানে ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ৫৫ হাজার। পাওয়ার টিলারের ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ। এসব যন্ত্রের মাধ্যমে মাটি কাটার প্রায় ৯০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যবহার হয় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। এই যন্ত্রের চাহিদা রয়েছে ১ লাখের বেশি। কিন্তু দেশে ব্যবহার হচ্ছে অনেক কম। ধান বীজ বোনার জন্য রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের প্রয়োজন ২ লাখ। অথচ দেশে এ যন্ত্রটির ব্যবহার হচ্ছে ১ হাজারেরও কম। শুধু ধান কাটার যন্ত্র রিপারের চাহিদা ১ লাখ। অথচ দেশে এ যন্ত্র রয়েছে মাত্র ৫ হাজার। ধান বোনার জন্য পিটিও সিডার আছে মাত্র আড়াই হাজার। দেশে এই যন্ত্রের চাহিদা রয়েছে ১ লাখ। একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের দাম ২৫-৩০ লাখ টাকার মধ্যে। বপন ও কর্তন যন্ত্রের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকদের জন্য ক্রয় করা কষ্টসাধ্য। আগামী বাজেটে সামগ্রিকভাবে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে এসব সীমাবদ্ধতা কাটানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর