সোমবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনায় আগাম বাজেট পরিকল্পনা

অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখতে আসছে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার বাজেট

মানিক মুনতাসির

করোনায় আগাম বাজেট পরিকল্পনা

করোনা মহামারীর আঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য অর্থনীতি পুনরুদ্ধারমূলক বাজেট দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। মনে করা হয়েছিল অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই কেটে যাবে করোনা মহামারী। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সে ধারণা আর সরকারের কোনো প্রক্ষেপণই কাজে আসেনি। বরং দিন দিন করোনার ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে সারা বিশ্বে। যদিও বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এর ভয়াবহতা অনেকটাই কম। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের আগাম প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। আসছে বাজেটেও সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে জনস্বাস্থ্য এবং করোনা মোকাবিলা। আগামী বাজেটের আকার হতে পারে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার বাজেট। বিশাল এই ব্যয়ের বাজেটের খসড়া রূপরেখায় মোট আয়ের পরিকল্পনা হচ্ছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা হবে জিডিপির ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে সেটি হওয়ার কথা ৪ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। করোনার কারণে রাজস্ব আয় কমিয়ে ধরছে এনবিআর। একইভাবে আসছে বাজেটে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির টার্গেটও কমিয়ে ৭ দশমিক ৭ ধরা হচ্ছে। বিশাল আকারের এই বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে ২ লাখ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। সূত্রমতে, সাধারণত প্রতিবছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে নতুন বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতি শুরু করে সরকার। এর অংশ হিসেবে অর্থ বিভাগ, এনবিআর, পরিকল্পনা কমিশন মিলে ত্রিপক্ষীয় সভা করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর চাহিদাপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে খসড়া প্রণয়ন করে। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে এ বছর তা কিছুদিন আগেই শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে গত ডিসেম্বরের বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম হাতে নেয় অর্থ বিভাগ। সে আলোকে বিভিন্ন দফতর, বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ও করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সম্পদ সীমিত। এরই মধ্যে করোনার আঘাতে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে রাজস্ব আয়ও কাক্সিক্ষত হয় না। তাই ঘাটতি বাজেট দিতে হয়। আর ঘাটতি অর্থায়নে যেসব রাস্তা রয়েছে, সেগুলোও সীমিত।’ তিনি বলেন, ‘ঘাটতি অর্থায়নে দেশীয় ও বিদেশি উৎস ভরসা। বিদেশি উৎস থেকে অর্থায়ন করলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবাহ ঠিক থাকে। আর দেশীয় মানেই ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র। ব্যাংক থেকে অনেক বেশি অর্থ নিলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। এ জন্য সরকারের উচিত হবে বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগবান্ধব কর্মসূচিকে প্রাধান্য দেওয়া।’

এদিকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এবারের বাজেটেও থাকবে এ ধরনের বাড়তি কর্মসূচি। এ ছাড়া ইতিমধ্যে করোনা মহামারীর প্রভাব মোকাবিলায় দেশের কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে গতি সঞ্চার, গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং অতিদরিদ্র বয়স্ক ও বিধবাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নতুন দুটি প্রণোদনা কর্মসূচি অনুমোদন করেছেন। কর্মসূচি দুটিতে মোট বরাদ্দ ২,৭০০ (দুই হাজার সাত শ) কোটি টাকা, যার বাস্তবায়ন শুরু হবে শিগগিরই। নতুন অনুমোদিত এই দুটিসহ মোট প্রণোদনা প্যাকেজের সংখ্যা দাঁড়াল ২৩টি। এতে মোট আর্থিক পরিমাণ দাঁড়াল ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে?উদ্দেশে এ দুটি নতুন প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন তা অবশ্যই কার্যকর হবে। নতুন এ দুটি প্রণোদনার মাধ্যমে আমাদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অত্যন্ত উপকৃত হবে। পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতিতে আরও গতির সঞ্চার হবে।’

সূত্র জানায়, সরকার মনে করে গত বছর শুরু হওয়া করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া অর্থনীতি এখনো শতভাগ স্বাভাবিক হয়নি। এর ফলে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হচ্ছে। চলতি বছরের টার্গেট রয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। অবশ্য সরকার মনে করছে চলতি অর্থবছর শেষে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধিই অর্জিত হবে। যদিও এর সঙ্গে একমত হয়নি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ কোনো উন্নয়ন-সহযোগী সংস্থাই। করোনাভাইরাসের অচলাবস্থার কারণে গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। অবশ্য ডিসেম্বর ২০২০ সময়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশই জিডিপিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে করোনা মহামারী সত্ত্বেও। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত কমিটির কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট কমিয়ে আনার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের আয়বর্ধন কর্মসূচি কীভাবে আরও কার্যকর করা যায় সে ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। ব্যয় না কমিয়ে কীভাবে আয় বাড়ানো যায় এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সাশ্রয় করে কীভাবে আরও কার্যকরভাবে বাজেটের অর্থ খরচ করা যায় সে ব্যাপারেও পরিকল্পনা কমিশন থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে অর্থ বিভাগের খসড়া হিসাব অনুযায়ী করোনা মহামারীর প্রভাবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের প্রথম মাসে ১০ হাজার ২২২ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯৬ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, যেখানে টার্গেট ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। তবে এনবিআরের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত এনবিআরের হিসাব বিবরণীমতে, নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে এনবিআর রাজস্ব আহরণ করেছে ৮৭ হাজার ৯২ কোটি ৭১ লাখ টাকা, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৯৫৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি ২৫ হাজার ৮৬৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, যেখানে গত অর্থবছর একই সময় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে যেসব খাত থেকে রাজস্ব আদায় করার পরিকল্পনা হচ্ছে তাতে নতুন কোনো খাত নেই। আবার নতুন করে বিপুলসংখ্যক মানুষকে করের আওতায় আনতেও এক ধরনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা মহামারী। কেননা করোনার অচলাবস্থার কারণে দেশের প্রায় সব শ্রেণির মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরের মধ্যে বা আগামী কয়েক বছরে নতুন করে যাদের করের আওতায় আনার পরিকল্পনা হয়েছিল, সেটাও পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। এদিকে আগামী বছর শুধু এনবিআরের রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আয় ধরা হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর কর-বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব সংগ্রহের কৌশল হিসেবে নির্ধারণ করা হচ্ছে- আয় করের আওতা বাড়ানো; ভ্যাট আইন, ২০১২-এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন; এর আওতায় ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা; কর ব্যবস্থায় কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা এবং সব ধরনের শুল্ক ফাঁকি রোধে ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার বন্ধে বন্ডেড ওয়্যারহাউসগুলোকে শতভাগ অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আসছে বাজেটটিতেও করোনা মহামারীর বিপর্যয় ঠেকানোকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে আসছে বাজেটে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর