মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

পানাম নগরের সোনালি অতীত

মোস্তফা কাজল

পানাম নগরের সোনালি অতীত

ঢাকার উপকণ্ঠের ৪৫০ বছরের পুরনো পানাম নগর প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম মাইলফলক। এ শহরের রয়েছে সোনালি অতীত। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে শুধুই নিস্তব্ধতা। মৃত নগরীর পথে পথে দেখা মেলে পর্যটকের চলাচল। বর্তমান করোনাকালেও ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের ঢল নামে পানাম নগরে। আগত পর্যটকরা দেখতে পান মৃত কোলাহল আর অব্যক্ত ইতিহাস যেন জড়িয়ে আছে এ নগরীর প্রতিটি ইটে। এ নগরের পথের দুই ধারে কালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন আর কাঠামোগুলো যেন হারানো জৌলুসের কথা জানান দিচ্ছে। এখন পানাম নগরের অবস্থা দেখলে বোঝা যায়, অনেক অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ভবনগুলো। কখন যেন অভিমান ধরে রাখতে না পেরে ভেঙে পড়বে তারা। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড বিশ্বের ১০০টি ধ্বংসপ্রায় নগরীর তালিকায় পানাম নগরের নাম অন্তর্ভুক্ত করে। অতিসম্প্রতি পানাম নগরের গিয়ে জানা যায়, প্রায় ৪৫০ বছর আগে এ নগর কতটা সমৃদ্ধ ছিল। বারবার ভাবতে বাধ্য করে রাস্তার দুপাশের দ্বিতল-ত্রিতল ভবনগুলো দেখলে। এখানে রয়েছে বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনা- মসজিদ, মন্দির ও প্যাগোডা। এ ছাড়া পানাম নগরের পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হতে পারে ঈশা খাঁর আমলের কথা। কেমন একটা রহস্য জড়িয়ে আছে পানাম নগরে! এ নগরের প্রতিটি ভবনে যেন মিশে আছে একেকটা কাহিনী। এখনো এই নগরের প্রতিটি ভবনের আকর্ষণের নেই কোনো কমতি। ভবনগুলোর নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। পানাম নগরের প্রকৃতি আর কোলাহলমুক্ত পরিবেশ মুহূর্তেই নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে।

একসময় বাংলার রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। এর পূর্ববর্তী নাম পানাম নগর। তাই সোনারগাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর আর নগর। সোনারগাঁয়ের ভৌগোলিক অবস্থানের দিকে নজর দিলেই এর গুরুত্ব বোঝা যায়। সোনারগাঁ চারদিক থেকে চারটি নদী দ্বারা বেষ্টিত। উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে ধলেশ্বরী, পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা। এমন ভৌগোলিক অবস্থান ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত। ১৩৪৬ সালে ইবনে বতুতা চীন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে সোনারগাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী রূপে বর্ণনা করেন। রাজধানীকে কেন্দ্র করে ক্রমেই গড়ে ওঠে এক অভিজাত শ্রেণি, যারা ছিলেন মূলত বণিক বা ব্যবসায়ী।

 অভিজাত শ্রেণির বসবাসের ফলে অন্যান্য এলাকা থেকে ব্যবসায়ী ও সওদাগরদের আনাগোনা লেগেই থাকত। পানাম নগরের প্রবেশপথের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ধনী হিন্দু বণিকদের দ্বারা এ নগরের প্রসার ঘটে। এ এলাকা প্রসিদ্ধ ছিল মসলিন কাপড় ও নীল ব্যবসার জন্য। বর্তমানে দর্শনার্থীরা যে পানাম নগর দেখতে যান, সেখানে একটিই মাত্র পাকা রাস্তা। ৬০০ মিটার দীর্ঘ আর ৫ মিটার প্রস্থ এ রাস্তার দুপাশে রয়েছে সব মিলিয়ে ৫২টি ভবন।

 ভবনগুলোতে স্থানীয় নির্মাণশিল্পের ছোঁয়া থাকলেও মূলত নির্মিত হয়েছে ইউরোপীয় ও মুঘল স্থাপত্যরীতির মিশ্রণে। একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে এখানে। ভবনের দেয়ালগুলো বেশ প্রশস্ত। দেয়ালগুলো বিভিন্ন আকৃতির ইট আর সুড়কি দিয়ে তৈরি। কিছু ভবনের দেয়ালের অলঙ্করণ দেখার মতো। নানা ধরনের নকশা, রঙিন কাচ, পাথর, কড়ি, চিনামাটি, টেরাকোটা ব্যবহার করা হয়েছে অলঙ্করণের জন্য। অধিকাংশ ভবনের মেঝে ধ্বংস হয়ে গেলেও টিকে আছে কয়েকটি। মেঝেগুলোর বেশির ভাগই লাল-সাদা-কালো মোজাইক করা এবং কয়েকটিতে দেখা যায় সাদা-কালো মার্বেল। পানাম নগরের প্রায় প্রতিটি ভবনের সঙ্গে রয়েছে ফাঁকা জায়গা বা উঠান। কোনোটি সামনে, কোনোটি পেছনে, আবার কোনোটি বাড়ির মধ্যখানে। রয়েছে পানির কূপ ও বাঁধানো পুকুরঘাট। নগর এলাকার চারপাশ ঘিরে রয়েছে গভীর খাল, যা নগরের প্রতিরক্ষার জন্য তৈরি পরিখা বলে ধারণা করা হয়। পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য পানাম নগর এখনো অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর