রবিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

সাপের বিষ পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট বাংলাদেশ

বিষ নয় প্রতারণা

আলী আজম

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে প্রায়ই ধরা পড়ছে কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ। বেশির ভাগ অভিযানে নকল সাপের বিষ ধরা পড়লেও দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্র বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। অতীতে যে বিষগুলো জব্দ করা হয়েছে তার বেশির ভাগই ফ্রান্স থেকে আসা বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সাপের বিষ বেচাকেনা নিষিদ্ধ হওয়ায় এবং বিষ ব্যবহারের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বিদেশে ওষুধ গবেষণা ও মাদক তৈরির উদ্দেশ্যেই পাচার হচ্ছে বিষগুলো। তবে এগুলো বিষ নয়, সাপের বিষের নামে প্রতারণা করছে চোরাকারবারি চক্রের সদস্যরা- এ ধারণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। বিভিন্ন সময় সীমানা পিলার ও তক্ষকের মাধ্যমে প্রতারক চক্রের টার্গেট ব্যক্তিদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিঃস্ব করার নজির রয়েছে। সাপের বিষের ক্ষেত্রে এ রকম হতে পারে। চক্রটি টার্গেট ব্যক্তিকে ভিআইপি হোটেলে নিয়ে ভুল বুঝিয়ে সাপের বিষের বিষয়ে অবহিত করে। পরে সাপের বিষের বৈয়াম দেখিয়ে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে সটকে পড়ে। সাপের বিষ বেশ দামি হওয়ায় পাচারকারীদের পছন্দের বস্তু। আর আশপাশের কয়েকটি দেশে বিষ পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিষ পাচার হয়। কখনো সেসব দেশ থেকে এনেও বাংলাদেশ হয়ে অন্য দেশে

নেওয়া হয়। সাপ, সাপের চামড়া বা বিষ রপ্তানির সুযোগ নেই। দেশের আইনে সাপের বিষ কেনাবেচা ও পাচার দন্ডনীয় অপরাধ। তার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধারণা, ফেনী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, যশোর, কুমিল্লাসহ কয়েকটি এলাকায় একাধিক চক্র সাপের বিষ সংগ্রহ ও চোরাচালানে জড়িত। দেশি-বিদেশি চোরাকারবারি চক্র প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকার গোখরোর বিষ ভারত ও ফ্রান্সে পাচার করছে।

জানা গেছে, প্রক্রিয়াজাত করা এক গ্রাম ভাইপার রাসেলের বিষের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এ ছাড়া কালচিতি সাপের বিষের দাম গ্রামপ্রতি ৩-৪ লাখ টাকা। বিভিন্ন সামুদ্রিক সাপের বিষের মূল্য ৪-সাড়ে ৪ লাখ টাকা। বাংলাদেশে ১৬ প্রজাতির বিষধর সাপ আছে, যেগুলোর বিষ অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৮ জানুয়ারি রাজধানীর রামপুরা থেকে ৮৫ কোটি টাকার সাপের বিষসহ আন্তর্জাতিক সাপের বিষ চোরাকারবারি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। সন্দেহজনক ১২ পাউন্ড সাপের বিষ লিকুইড ও ক্রিস্টাল হিসেবে পাওয়া যায়। র‌্যাব বলছে, বিষগুলোর সঙ্গে পাওয়া ম্যানুয়াল অনুযায়ী এগুলো ফ্রান্সের তৈরি। পাচারের উদ্দেশ্যেই চোরাপথে বাংলাদেশে এসেছে। তবে বিষগুলো আসল কিনা সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নয় র‌্যাব। এর আগে ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখানে ৭৫ কোটি টাকার প্রায় ৯ কেজি কোবরা সাপের বিষসহ আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্রের ছয় সদস্য গ্রেফতার হন।

শুধু এ দুই অভিযানই নয়, কিছু দিন পরপরই ধরা পড়ছে সাপের বিষের চালান। ২৫ নভেম্বর গাজীপুর থেকে প্রায় ৯ কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার করে সিআইডি। একই বছরের জুনে ফেনীতে ২ পাউন্ড সাপের বিষসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ২০১৭ সালে ঢাকা থেকে ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করে পুলিশ; যার মূল্য প্রায় ৬৮ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গা থেকে ১২ কোটি টাকার বিষ উদ্ধার হয়। সাপ ও সাপের বিষের গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু রেজা বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে বিষ জব্দ করে সেগুলো পরীক্ষায় নকল প্রমাণিত হয়েছে। তবে দেশে যে বিষ ধরা পড়ছে সেগুলোয় রেড ড্রাগন, মেড ইন ফ্রান্স লেখা দেখা যায়। বাস্তবতা হলো, ফ্রান্সে কোনো বিষই উৎপাদন হয় না। এমনকি কোনো খামারও নেই। সারা পৃথিবীতে আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি কোম্পানি বিষ সরবরাহ করে। সুতরাং দেশের মধ্যে যে বিষ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো প্রতারণা ও একটি গোষ্ঠীকে প্রলোভন দেখাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের প্রতারণা হয়। জব্দ সাপের বিষের কৌটায় প্লাস্টিক ও চিনির দানার মতো দেখা যায়। এগুলো পরীক্ষায় নকল প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন সময় ধরা পড়া বিষ পরীক্ষা করে ছয়টি বৈয়ামে ছয় রকমের পদার্থ দেখা গেছে। সাপের বিষ মূলত ওষুধ গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়। সীমানা পিলার, তক্ষকের মতো সাপের বিষ দিয়ে প্রতারণা করছে একটি চক্র।’

বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক অসীম মল্লিক বলেন, ‘বিভিন্ন সময় ধরা পড়া কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হয় না। দেওয়া হলে আমরা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখতাম বিষ আসল না নকল। বাংলাদেশে যে কয়েকটি খামার রয়েছে সেগুলো থেকে বিষ উৎপাদন করা কিন্তু খুবই কঠিন। কেউ যদি অবৈধভাবে সাপের বিষ উৎপাদন ও আহরণ করে বিক্রির চিন্তা-ভাবনা করেন তবে সেসব খামার বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিষ পাচারে আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হচ্ছে।’

র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘বিষ পাচারকারীদের কয়েকটি সিন্ডিকেটের সন্ধান মিলেছে। বিভিন্ন অভিযানে উদ্ধার হওয়া সাপের বিষের লেভেলিং দেখেই বোঝা যায় এগুলো বিষধর সাপের বিষ। তবে যারা ধরা পড়ছেন তারা মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন। মূল হোতাদের সন্ধান চলছে।’ সাপের বিষের নামে একটি চক্র প্রতারণা করছে বলেও তার ধারণা।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, ‘সাপের বিষের দুটি চালান ধরেছে সিআইডি। প্রথম চালান পরীক্ষা করে ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয় চালান ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে। সাপের বিষ পাচারের ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে পারে পাচারকারীরা। এ ছাড়া সাপের বিষের প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পারে প্রতারক চক্র।’

সর্বশেষ খবর