বুধবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনায় লাগামহীন অপরাধ

আর্থিক দৈন্য ও কর্মহীনতাকে নিয়ামক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা

সাখাওয়াত কাওসার

করোনায় লাগামহীন অপরাধ

ঘটনা-১ : রাজধানীর বাড্ডা এলাকার ফল ও কাপড় ব্যবসায়ী আপেল মাহমুদ। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর ব্যবসা গুটিয়ে এক প্রকার কর্মহীন হয়ে পড়েন। সংসার চালাতে একপর্যায়ে কিছু বন্ধু মিলে প্রতারণা শুরু করেন। তারা স্ত্রীদের দিয়ে অপরিচিত লোকজনের ফাঁদে ফেলে আটক, নির্যাতন ও অর্থ আদায় করতেন। সাঈদ নাগর নামের এক ব্যক্তি তাদের ফাঁদে পড়ে টাকা না দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করায় তাকে হত্যা করেন। গত বছরের ১২ জুলাই আপেল ও তার স্ত্রী গ্রেফতার হন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে।

ঘটনা-২ : গত বছরের জুনে রাজধানীর ৩০০ ফুট এলাকায় কয়েকজন সিএনজিচালক একজন ঝুট ব্যবসায়ীকে খুন করেন। লকডাউনে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকদের আয় কমে গিয়েছিল। ঝুট ব্যবসায়ীও গার্মেন্টসের কাপড় পাচ্ছিলেন না। ওই ঝুট ব্যবসায়ী শুরু করেছিলেন চা-পাতা, আদা ও মধুর ব্যবসা। আর কয়েকজন সিএনজিচালক গড়ে তুলেছিলেন ছিনতাইকারী চক্র। গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার নাম করে চক্রটি ওই ব্যবসায়ীকে হত্যা করে টাকা লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনা-৩ : চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগান এলাকার ডলফিন গলির একটি বাসায় মাস্টার মাইন্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ও-লেভেল পড়ুয়া এক ছাত্রীকে ‘গ্রুপ স্টাডি’র নামে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে তারই সহপাঠী দিহান। পরে বন্ধুদের সহযোগিতায় হাসপাতালে রেখে চলে যায় তারা। চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই মৃত্যু হয় এই কিশোরীর। ধর্ষণের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করে ঢামেক ফরেনসিক বিভাগ।

ঘটনা-৪ : গত শনিবার রাত ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে একটি কাঁঠাল গাছে এক কিশোরীর মরদেহ ঝুলে থাকতে দেখে কয়েকজন মহিলা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক কিশোরীকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশের ধারণা, ধর্ষণের চেষ্টা করার পর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মেয়েটিকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল কেউ।

এমন সব ঘটনার পাশাপাশি করোনা মহামারীর পুরো সময় জুড়েই ছিল অরাজকতা। মহামারীর প্রভাবে সৃষ্ট বেকারত্বে বেড়েছে সামাজিক অপরাধ। মারাত্মকভাবে বেড়েছে সামাজিক অস্থিরতা। গৃহকর্মীরাও হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর। তাদের কাছেও নিরাপদ থাকছে না শিশু এমনকি ঘরের বৃদ্ধরাও। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ঝুলছে সমাজ তথা পরিবারের সদস্যরাও। ভয়ংকর প্রতারণা, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ সামাল দিতে হাঁপিয়ে উঠছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। বিশেষ করে ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারানোর ঘটনা বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের মার্চে দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে, এমনটাই চিন্তা করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ বিষয়ে বিশেষ নজর রাখার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে। তবে সামাজিক অপরাধের পাশাপাশি খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি, বিকৃত যৌনাচার, এমন সব অপরাধ বৃদ্ধি পায় মহামারীর এই সময়ে। আর্থিক দৈন্যতা এবং কর্মহীনতাই এসব অপরাধের মূল নিয়ামক হিসাবে দেখছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

গত ১৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় অজ্ঞাত নামা এক ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রোগ্রামে ৮০ প্যাকেট খাবার অর্ডার দেবে বলে মিহির রায়কে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। এরপর মিহিরের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। ১৪ জানুয়ারি মিহিরের নম্বর থেকে মিহিরের স্ত্রীর নম্বরে ফোন আসে। কিন্তু কোনো কথা না বলে কেটে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর অন্য একটি নম্বর থেকে কল এলে রিসিভ করেন মিহিরের স্ত্রী। ওপাশ থেকে মিহির বলেন, এরা আমার হাত-পা ও চোখ বেঁধে রেখেছে। ২০ লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দেবে। পরে তার স্ত্রী বিভিন্ন সময়ে অপহরণকারীদের দেওয়া নম্বরে ২ লাখ ৯১ হাজার টাকা ‘বিকাশ’ করে। অবশিষ্ট টাকা না দিলে তার স্বামী মিহিরকে ক্ষতির হুমকি দেয় অপহরণকারীরা। পরে এ ঘটনার তদন্তে নেমে অপহরণ চক্রের এক নারী সদস্যসহ দুজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তরা) একটি দল। পরে জানা যায়, মিহিরের মতো আরও অনেককে এই চক্রটি অপহরণ করে নারীদের সঙ্গে অশ্লীল দৃশ্য ভিডিও করে রাখত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনার বেকারত্বের প্রভাবে কিছু উদাহরণ আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছি। ব্যক্তি ছাড়াও অনেক ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান ভয়াবহভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে স্কুল-কলেজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় শিশু এবং কিশোরদের ওপর নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে কিশোররা অতিমাত্রায় ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে গেছে। বিভিন্ন সাইটে তারা ঢুকে পড়ছে। বিকৃত মানসিকতার জন্ম হচ্ছে। সম্প্রতি আনুশকা হত্যাকান্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। খোদ ইউনেস্কোই নানা বিষয় নিয়ে আশঙ্কার কথা বলেছে।

গত বছরের এপ্রিলে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে কুতুব উদ্দিন (৩৪) নামে এক মাছ ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার পর লাশ ড্রেনে ফেলে দেয় দুর্বৃত্তরা। একই দিন রংপুর নগরীতে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কথা কাটাকাটির মতো তুচ্ছ ঘটনায় জহুরুল ইসলাম (৪৫) নামে স্যাটেলমেন্ট অফিসের এক কর্মচারীকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। বগুড়া সদর উপজেলায় ভাশুর, জা ও ভাতিজার নির্মম পিটুনি ও রডের আঘাতে সালমা বেগম (৩২) নামে এক গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় এক প্রবাসীর স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ একই পরিবারের চারজনের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন সাতক্ষীরার কলারোয়ায় প্রেম করার জেরে মোবাইল ফোনে ডেকে এনে বেদম পিটিয়ে এক কলেজছাত্রকে হত্যার অভিযোগ ওঠে প্রেমিকার পরিবারের বিরুদ্ধে।

সূত্র বলছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধের সংখ্যা ছিল ৩২০, ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই অপরাধ দাঁড়িয়েছিল ৫৯৮টিতে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চাঁদা দাবি বা আদায়ের চেষ্টা, ছিনতাই ও ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টায় করা অপরাধের সংখ্যা। ২০১৯ সালে চাঁদা দাবি বা আদায়ের চেষ্টায় মামলা হয়েছিল ৬৭টি, ২০২০ সালে একই সময়ে মামলা হয়েছে ১০৩টি। চাঁদা দাবি বা আদায় চেষ্টায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা অঞ্চলে (রেঞ্জে)। এর সংখ্যা ২৩। এরপরই রাজশাহী অঞ্চলের অবস্থান। করোনা শুরুর পর আট মাসে দেশে ছিনতাইয়ের মামলা হয় ৩৫৬টি। ১৯-সালের একই সময়ে এ ধরনের ঘটনা ছিল ১৯৩টি। পরিসংখ্যান বলছে, সবচেয়ে বেশি ছিনতাই হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ২০২০ সালের অপরাধ পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ডাকাতি ২১টি, দস্যুতা ১৭৬, খুন ২১৯, দ্রুত বিচার আইনে ১০৫, নারী ও শিশু নির্যাতন ২১৯৮ (ধর্ষণ ৫৬৯), অপহরণ ৪৪, পুলিশ আক্রান্ত ৫৪, সিঁধেল চুরি ৬৫৮, গাড়ি চুরিসহ মোট চুরি ১২১৭, অস্ত্র বিস্ফোরক-মাদকসহ মামলা মোট ১২ হাজার ৮৪৬টি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ১৭১৮টি শিশু ধর্ষণের ধর্ষণ ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৮৬টি মামলা হয়েছে। নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৬২৭টি। এসব ঘটনায় মামলার সংখ্যা ১১৪০টি। ধর্ষণের কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৫৩টি। স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুনের ঘটনা ঘটেছে ২৪০টি। গৃহকর্মী নির্যাতন ৪৫টি। এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন আটজন। নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন দুজন। পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, করোনাকালে মানুষের আয় রোজগারের পথ মসৃণ ছিল না। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পৃথিবীজুড়েই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গৃহে অন্তরীণ থাকতে হয়েছে মানুষকে। এসব কারণে মানুষের শারীরিক উপস্থিতি ও অর্থ-সম্পত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধের প্রকৃতি ও পরিমাণে পরিবর্তন অস্বাভাবিক নয়। তিনি আর বলেন, করোনাকালে নানামুখী পুলিশি তৎপরতার মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বাংলাদেশ পুলিশ। তবে যে সব অপরাধের পিছনে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইত্যাদি বিষয়াদির প্রভাব রয়েছে তা দমন ও নির্মূলে পুলিশিং-এর পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক উদ্যোগও বিবেচনায় নিতে হবে।

সূত্র বলছে, মহামারীর এই সময়ে চাঁদাবাজি এবং প্রতারণায়ও যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। সম্প্রতি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত ও আরমানের পরিচয় দিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে চাঁদা দাবি করার ঘটনা ঘটে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রূপালী ব্যাংক তাদের শাখা ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, করোনা মহামারীর কারণে বেসরকারি খাতের ছোট, মাঝারি ও বড় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কাজ হারানো এসব মানুষ সংসার চালানোর জন্য প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে। প্রতারণার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, করোনাকালে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে সত্য। তবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য র‌্যাব সদর দফতর থেকে সবগুলো ব্যাটালিয়নে এ সংক্রান্তে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। র‌্যাব সদস্যরা মানবিক কর্মকান্ডসহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাদের সর্বোচ্চটাই দিচ্ছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর