শিরোনাম
শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

তদন্তের সঙ্গেই মিশে ছিল খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

তদন্তের সঙ্গেই মিশে ছিল খুনি

নরসিংদীর একটি দুর্গম এলাকা বাহের চর। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গ্রামের দুটি প্রভাবশালী গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্ব। কিছুদিন পর পরই বিবদমান এই দুটি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। দেশীয় অস্ত্র টেঁটা, বল্লম, বর্শা ব্যবহার হয় এসব সংঘর্ষে। সংঘর্ষ শুরু হলে নারী বৃদ্ধরাও ঘরে বসে থাকেন না। বল্লম, বর্শা হাতে নিয়ে তারাও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। আহত হয়ে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে উভয় গ্রুপের অসংখ্য মানুষ। এরপরও তারা শান্ত হয়নি। কোনো কিছুর অজুহাতে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন শাহজাহান ভূঁইয়া। অপর গ্রুপের নেতৃত্বে সাবেক মেম্বার বাচ্চু। পুলিশ প্রশাসন এদের দুই গ্রুপের কাছে যেন অসহায়। ২০১৫ সালের ২৮ মার্চ। বাহেরচর গ্রামের একটি ধানখেতে ১১ বছরের একটি শিশুর গলা কাটা লাশ পড়ে ছিল। শিশুটির শরীরে অসংখ্য আঘাত। ভারী কিছু দিয়ে মাথা থেঁতলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যায় রক্তাক্ত লাশ দেখে স্থানীয় লোকজন হাঁকডাক শুরু করে। এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে শিশুটির চেহারাই চেনা যাচ্ছিল না। শিশুর লাশ উদ্ধারের সংবাদে হ্যাজাক বাতি নিয়ে লোকজন দলে দলে ছুটতে থাকে ধানখেতের দিকে। ছুটে আসা লোকজনের মধ্যে ছিলেন বাহের চর গ্রামের বাসিন্দা মোতালেব হোসেনও। হ্যাজাক বাতি শিশুর নিথর দেহের সামনে ধরতেই গগনবিদারি চিৎকার শুরু করেন মোতালেব। নিজের আদরের কন্যা ইলমার দেহ চিনতে ভুল হয়নি মোতালেবের। ইলমার রক্তাক্ত দেহ জাপটে ধরে বিলাপ শুরু করেন। খবর শুনে ইলমার মা, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন ছুটে যায় ধানখেতে। তাদের আহাজারিতে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হতে থাকে। দলে দলে ছুটে আসা নারী পুরুষ তাদের আহাজারিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। সবার এক প্রশ্ন, এমন ফুটফুটে শিশুটিকে মারল কোন পাষন্ডের দল? পাগলপ্রায় হতভাগ্য বাবা মোতালেব আহাজারি করছিলেন, আর বলছিলেন- ‘তোরা আমার জান নিতি। আমার এই ১১ বছরের মাসুম বাচ্চাটারে কেন মারলি? কী দোষ করেছে আমার বাচ্চা।’ বাহেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল ইলমা। সংবাদ পেয়ে পুলিশ আসে। ঘটনাস্থল এবং আশপাশে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে। শোকে পাথর ইলমার বাবা-মায়ের কাছে যায় পুলিশ। সান্ত্বনা দিয়ে বলে, কাউকে সন্দেহ হয় কি না। তখন মোতালেব পুলিশকে জানান, মামলা করবে বাচ্চু গ্রুপের লোকজনের বিরুদ্ধে। তারাই তার বাচ্চাকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ করেন মোতালেব। মোতালেব হলেন প্রভাবশালী শাহজাহান ভুইয়া গ্রুপের লোক। বাচ্চু গ্রুপের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে মোতালেব এবং তার গোষ্ঠীর লোকজন থাকে সম্মুখ ভাগে। মোতালেবের সন্দেহ, শাহজাহান ভুইয়াকে শায়েস্তা করতেই তার শিশু কন্যাকে হত্যা করেছে। ঘটনার রাতে ওই এলাকায় বাচ্চু গ্রুপের লোকজনকে এলাকার কেউ কেউ ঘুরতে দেখেছে বলে জানতে পেরেছে মোতালেব। ঘটনার তিন দিন পর ৩১ মার্চ ইলমার বাবা মোতালেব বাদী হয়ে প্রতিপক্ষ বাচ্চু গ্রুপের বিলকিস বেগম, খোরশেদ ও নাসুসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে নরসিংদী সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। নরসিংদী থানা পুলিশ শিশু ইলমা হত্যার তদন্ত শুরু করে। কিন্তু থানা পুলিশ এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না। থানায় ঘুরতে ঘুরতে মোতালেব পুলিশের ওপর নাখোশ। একপর্যায়ে মামলার তদন্ত যায় ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)-এর কাছে। তদন্ত করে হত্যা সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্যই খুঁজে পায় না পুলিশ। হত্যাকারীদের কেউ দেখেছে, এমন কোনো ব্যক্তিরও সন্ধান পাওয়া যায় না। সিআইডি হতাশ। তারা আসামি গ্রেফতারে জোর দেয়। তদন্তের এক পর্যায়ে এজাহারভুক্ত তিনজনের মধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় সিআইডি। সিআইডি নিশ্চিত হয়, এবার হয়তো খুনের রহস্য উদঘাটন হবে। কিন্তু না, রিমান্ডে নিয়েও হত্যার কোনো ক্লু খুঁজে পাওনা যায় না। কোনো তথ্যই পায় না সিআইডি। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। পরে তারা জামিনে ছাড়া পান। অন্যদিকে হত্যার রহস্য উদঘাটনে তদন্ত অব্যাহত রাখে সিআইডির কর্মকর্তারা। সিআইডির তদন্তেও নাখোশ হয় ইলমার বাবা মোতালেব। আসামি কেন গ্রেফতার হচ্ছে না, এ নিয়ে প্রশ্ন করেন কর্মকর্তাদের কাছে। কর্মকর্তারা তাকে জানায়, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে নতুন তথ্য দেয় মোতালেব। নতুন কয়েকজনের নাম সিআইডি কর্মকর্তাদের হাতে দিয়ে মোতালেব বলেন, এরাই জড়িত তার মেয়ে ইলমা খুনে। আগে যাদের নাম দেওয়া হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে তারা জড়িত নয় বলে সে জানতে পেরেছেন। সিআইডি তার দেওয়া তথ্য নিয়ে তদন্ত করে। এবারও সিআইডি ব্যর্থ। কোনো তথ্যই পায় না। দিন মাস বছর পেরুতে থাকে। ইলমা হত্যার রহস্য উদঘাটন হয় না। মাঝেমধ্যে মোতালেব যোগাযোগ করে নিত্য-নতুন নাম দেয়। তাদের গ্রেফতারে চাপ দেয় মোতালেব। নিত্য-নতুন নাম দিয়ে গ্রেফতারে চাপ দেওয়ার বিষয়টি সিআইডির খটকা লাগে। তারা এবার মোতালেব এবং তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নজরদারি শুরু করে। মোতালেবের অতীত ইতিহাস জানার চেষ্টা করে। সিআইডির গোয়েন্দারা জানতে পারে, ২০১৩ সালে মোতালেবের বাড়িতে আগুন লাগে। এ সময় মোতালেব কয়েকজনকে আসামি করলেও তদন্তে বেরিয়ে আসে হতবাক করা তথ্য। মোতালেব নিজেই আগুন ধরিয়ে অন্যকে ফাঁসিয়েছিলেন বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। এমন তথ্য জানার পর নড়েচড়ে বসে গোয়েন্দারা। তদন্ত এগিয়ে যায়। সিআইডি মোতালেবের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ভাগ্নে মাসুমের নাম জানতে পারে। এই মাসুমও শাহজাহান ভুঁইয়া গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। কিন্তু মাসুমকে কোথাও খুঁজে পায় না সিআইডি। সিআইডি জানতে পারে, ইলমা খুনের পর থেকেই মাসুমকে আর দেখা যায়নি। তার সন্ধানে বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালাতে থাকে সিআইডি। তাছাড়া ইলমার বোনজামাইও বিদেশে চলে যায় খুনের পর। আর আসেননি। সিআইডির এমন তদন্ত চলতে চলতে কেটে যায় পাঁচ বছর। অবশেষে ২০২০ সালে সিআইডি মাসুমকে গ্রেফতার করে। মাসুম ইলমা হত্যার চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয় সিআইডিকে। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে মাসুম ইলমা হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। মাসুমকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, মাসুমের সঙ্গে বাচ্চু গ্রুপের সদস্য তোফাজ্জলের মেয়ে তানিয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ে করার জন্য মাসুম তানিয়াকে নিয়ে যায়। টের পেয়ে তানিয়ার বাবা দলবলসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে তানিয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় তানিয়ার বাবা বাদী হয়ে মাসুম, মাসুমের ভাই খসরু ও ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে নরসিংদী সদর থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। বাচ্চু গ্রুপের সদস্যদের ক্ষতি করার জন্য আরেক গ্রুপের দলনেতা শাহজাহানের বাড়িতে ২০১৫ সালের ১ মার্চ রাতে মাসুমসহ ১৩ জন বৈঠক করে। প্রতিশোধ নিতে একটি হত্যাকান্ড ঘটিয়ে বাচ্চু গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার বিষয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শাহজাহান ভুঁইয়া মোতালেবকে তার মেয়ে ইলমাকে টাকার বিনিময়ে হত্যা করার প্রস্তাব করেন। মোতালেব ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে মেয়েকে হত্যা করতে রাজি হন! চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালের ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় ইলমার দুলাভাই ও অন্যরা মিলে ইলমাকে টাকা দেয় দোকান থেকে কিছু কিনে আনতে। তখনই পিছু নিয়ে ইলমাকে ধরে নিয়ে যায় ধানখেতে। সেখানেই তাকে প্রথমে পিটিয়ে পরে জবাই করে হত্যা করা হয়। জেরার মুখে মাসুম জানায়, মরদেহ ধানখেতে ফেলে দেওয়ার সময় শাহজাহানের কাছে ইলমার বাবা ‘আগে টাকা দাও পরে কাম সারো’ বলে টাকা দাবি করেছিল। তবে চুক্তির ৩০ লাখ টাকা ইলমার বাবা পাননি বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। মাসুমের স্বীকারোক্তিতে ইলমার পাষ- বাবা আবদুল মোতালেব, মা মঙ্গলী বেগম, প্রতিবেশী বাতেন ও শাহজাহান গ্রুপের প্রধান শাহজাহান ভুঁইয়াকে গ্রেফতার করে সিআইডি। আর বোনজামাই বাবুল বিদেশে থাকায় গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ জানায়, তদন্তের সঙ্গেই মিশে ছিল খুনি। যে কারণে খুনিকে সন্দেহ করা যায়নি। হতভাগ্য শিশু ইলমার বাবা পুলিশ ও সিআইডির তদন্ত কোন দিকে যায়, তা সব সময় পর্যবেক্ষণে থাকত। যে কারণে খুনের রহস্য উদঘাটনে দীর্ঘ ৫ বছর লেগে যায়।

সর্বশেষ খবর