রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মহামারীতে গড়ে উঠছে নতুন উদ্যোক্তা

সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বিকল্প কর্মসংস্থানের

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

মহামারীতে গড়ে উঠছে নতুন উদ্যোক্তা

করোনা মহামারীতে কর্মসংস্থানের বাজার সংকুচিত হলেও ছোট ছোট উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে গ্রাম-গঞ্জে। কেউ নিজের জমিতে, আবার কেউবা জমি লিজ নিয়ে মাছের ঘের, মুরগির খামার, উচ্চজাতের গবাদিপশুর খামার গড়ে তুলছেন। ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাটের ধারা ইউনিয়নের মো. রাসেল ঢাকার মিরপুরে একটি কলেজ হোস্টেলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত মার্চের পর থেকে করোনা মহামারীর পর শিক্ষার্থীদের আবাসিক হোস্টেলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে গবাদিপশুর খামার গড়ে  তোলেন রাসেল। এখন তার খামারে ছোট-বড় ১০টি গরু রয়েছে, যা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫০ কেজি দুধ পাওয়া যায়। বিক্রি করার পর এ থেকে মাসিক আয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। রাসেল জানান, ম্যানেজারের চাকরি হারিয়ে তিনি তার প্রবাসী ভাইদের সহায়তায় যে প্রকল্পটি গড়ে তুলছেন সেটি তাকে আরও বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার একজন তরুণ উদ্যোক্তা নোমান মাহমুদ। ২০১৯ সালে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যাংক ঋণে মাছের ঘের ও মুরগির খামারের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। দুই বছরে এখন তার বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল তিনি জানান, এখন তার বাবার ২৫ বিঘা জমিতে নতুন করে আরেকটি মাছের ঘের করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে আরও ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে তার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বাইরে এভাবেই  ছোট ছোট নতুন উদ্যোক্তা গড়ে উঠছে গ্রাম-গঞ্জে। চাকরির পেছনে না ঘুরে এখন তারা নিজেরাই নিজেদের প্রকল্পে শ্রম দিচ্ছে। সেখানে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে করোনা মহামারী একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমলেও বেড়েছে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ। অনেকেই আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে নিজেদের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করছেন।

দেশের অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে জোর দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এ লক্ষ্যে একটি প্রকল্পও গ্রহণ করেছে। দুই বছরে ২৪ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ‘উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বিডা। ওই প্রকল্পের সারা দেশের ৬৪টি জেলায় এ পর্যন্ত প্রায় ২১ হাজার আগ্রহীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার জন এখন নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে নানা ধরনের প্রকল্প গড়ে তুলেছেন। বিডার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ ও ২০২০ সালে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর সারা দেশে ৩ হাজার ৬৭০ জন উদ্যোক্তা নিজেদের প্রকল্প গড়ে তুলেছেন। তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে ৯৮৫ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ হয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ৩২ হাজার মানুষের। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটির আওতায় সারা দেশ থেকে বিনিয়োগে আগ্রহী এমন ২৪ হাজার শিক্ষিত বেকারকে বাছাই করা হয়। প্রশিক্ষণ  নেওয়ার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছিল এইচএসসি পাস আর বয়স ধরা হয়েছিল ১৮-৪৫ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে ৬৪টি  জেলায় ২০ হাজার ৮০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে কেউ মাছের ঘের, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ, মুরগির খামার, ডিজিটাল প্রিন্টিং, তথ্য প্রযুক্তি, প্লাস্টিক, চামড়া এমনকি তৈরি পোশাক কারখানা শিল্পেও বিনিয়োগ করেছেন কেউ কেউ। বিডার কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অনলাইনে নিবন্ধন করে প্রশিক্ষণে যুক্ত হওয়া যায়। সারা দেশের ৬৪ জেলায় প্রতি মাসে ২৫ জন করে আগ্রহীকে এক মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের আগস্টে শুরু হওয়ার পর এ প্রশিক্ষণ কর্মশালা আগামী জুলাই মাস পর্যন্ত চলার কথা। তবে প্রকল্পটি থেকে সুফল মেলায় এর মেয়াদ আরও বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশিক্ষণের পর আর্থিক সহায়তার জন্য প্রশিক্ষণার্থীদের বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তাদের মেন্টর হিসেবে স্থানীয় ব্যবসায়ী চেম্বার, অ্যাসোসিয়েশন ও সফল ব্যবসায়ীরা নিয়োজিত রয়েছেন। এ ছাড়া বিনিয়োগ বিষয়ক সার্বিক সহায়তার জন্য প্রতিটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি করে উদ্যোক্তা সহায়তা ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। তবে বিডার নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি কিছু সমস্যার কথাও শোনা গেছে নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার উদ্যোক্তা সোহাগ মোল্লা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ২০১৯ সালের শেষের দিকে বিডার নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর এখনো তিনি কোনো সংস্থা থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা পাননি। সোহাগ মোল্লা বলেন, ‘আমি বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়েছি। তাদের কাছে প্রকল্প সংক্রান্ত সব ধরনের কাগজপত্র জমা দিয়েছি। কিন্তু আমার বাবার নামে জমির দলিল বিধায় তারা কেউ আমাকে ঋণ দেয়নি।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলো সবসময় বড় বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে চায়। তারাও যেহেতু ব্যবসা করে, নিরাপত্তার স্বার্থে ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের এড়িয়ে যেতে চায়। তবে বিডায় প্রশিক্ষণের পর আগ্রহী উদ্যোক্তারা যাতে সহজে ঋণ সুবিধা পায় সে বিষয়ে আমরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলছি। প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম বলেন, যেহেতু উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্পটি থেকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব মিলছে, সে কারণে এটির মেয়াদ আরও ৬ মাস বাড়ানো হতে পারে। প্রকল্প থেকে এটিকে আরও বড় পরিসরে একটি প্রোগ্রামে রূপান্তর করা যায় কিনা সে বিষয়ে বিডাকে পরামর্শ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আর পুরো প্রকল্পটি মূল্যায়ন করে একটি স্টাডি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর