সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

অপরাধে কিশোর-কিশোরীরা

করোনাকালেও বেড়েছে অপরাধ গ্যাং কালচার আসক্তি, পাল্টেছে ধরন

সাখাওয়াত কাওসার

অপরাধে কিশোর-কিশোরীরা

চলতি বছরের শুরুতেই গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগান এলাকার ডলফিন গলির একটি বাসায় মাস্টার মাইন্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ও-লেভেল পড়ুয়া এক ছাত্রীকে ‘গ্রুপ স্টাডি’র নামে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে তারই সহপাঠী দিহান। পরে বন্ধুদের সহযোগিতায় একটি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে রেখে চলে যায় তারা। চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই মৃত্যু হয় আনুশকার। ধর্ষণের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ। এই ঘটনায় জড়িত সবাই কিশোর। ঘটনার পরপরই বেরিয়ে আসতে থাকে দিহানের বেপরোয়া জীবন কাহিনি। এই বয়সেই সে বন্ধুদের নিয়ে রাতভর আড্ডা দিত। ডুবে থাকত নেশায়। একাধিক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল তার। বেপরোয়া ড্রাইভিং, মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করত। দিহানের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ছিল তার বাবা-মায়ের। এই ঘটনার ঠিক ২১ দিন পর ২৮ জানুয়ারি অতিরিক্ত মদপানে ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর নির্মম মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রায়হান, নেহা এবং শাফায়েত জামিল নামে তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন। নিহত ওই কিশোরীর বাবার দায়ের করা মামলায় রায়হানকে ধর্ষণের পর হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের শেষ দিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এক নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করার দৃশ্য ভাইরাল হলে তা সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়।

এ ছাড়া সাম্প্রতিক কিশোর/তরুণদের নানা ঘটনা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলছে সংশ্লিষ্টদের। কারণ, এই কিশোর-কিশোরীরাই যে আগামী দিনের কান্ডারি! যেখানে পৃথিবী জুড়ে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ, তখনো গড্ডালিকায় গা ভাসাচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার সুযোগকে ভিন্নভাবে কাজে লাগাচ্ছে বিপথগামী কিশোর-কিশোরীরা। জড়িয়ে পড়ছে নানা অসামাজিক ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে।

অপরাধ ও শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, এমনিতেই লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই, উপরন্তু অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজনে এখন তাদের হাতে শোভা পাচ্ছে অত্যাধুনিক অ্যান্ড্রয়েড ফোন। ক্লাসের প্রয়োজনে হাতে হাতে মোবাইল ফোন; যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া হয়েছে। উঠতি বয়সের ছেলেদের ঘরে আটকে রাখা আরও বেশি কষ্টকর হয়ে পড়ছে এ নতুন ডিভাইসের কারণে। মোবাইল হাতে পেয়ে কেউ কেউ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে অশ্লীল ভিডিও দেখছে। ফেসবুকের সুবাদে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমে। কেউ একধাপ এগিয়ে বিয়ে-শাদি করে ফেলছে। মানছে না সরকার নির্ধারিত বয়সের পরিসীমা। কোথাও বা ছোট-বড় কিশোর গ্যাং সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। অনুসন্ধান বলছে, করোনাকালে কিশোরদের মধ্যেও বেড়েছে অপরাধ প্রবণতাসহ ‘গ্যাং কালচার’র আসক্তি। লকডাউনে অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের অপরাধের ধরনও অনেকটা বদলেছে। এ সময় অপরাধের সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে প্রযুক্তি। অলস সময়ে এই বয়সী কিশোরদের যৌনতার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। তাদের এই আগ্রহের জায়গায় প্রযুক্তি সহায়ক ভূমিকা রাখছে। উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানে ঘটে যাওয়া দিহান-আনুশকার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তারা অনলাইন ঘেঁটে শুধু শিক্ষামূলক কনটেন্টই দেখছে, এমন না। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে যায় না এমন অনেক অনৈতিক কনটেন্টও সার্চ করছে।

শিশু-কিশোরদের মনোবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক বিশেষজ্ঞের মতে, তারা অনলাইনে এখন যে ধরনের স্ট্যাটাস শেয়ার করে সেগুলো অন্য স্বাভাবিক সময়ের মতো না। এসব স্ট্যাটাসের শব্দ, বাক্যগঠন এবং অ্যাপিলও অন্যান্য সময়ের মতো না। এগুলোর ‘ইনার মিনিং’ থাকে আলাদা। দেখা যায় কারও ছবি বিকৃত করে পোস্ট করা হয়েছে। ভিডিও আদান-প্রদানে বৈচিত্র্য রয়েছে। সাইবার আইন অনুযায়ী এগুলোও অপরাধ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নূর মোহাম্মদ বলেন, এই কিশোররাই কিন্তু আগামী দিনে দেশের হাল ধরবে। অথচ আমাদের কিশোররা কি সঠিক পথে হাঁটছে? আমরা কি তাদের সুষ্ঠু বিনোদন কিংবা খেলাধুলার পরিবেশ দিতে পারছি? পরিবারও কি তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে? সম্প্রতি আমি নিজেই এমন একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। পরে সেখানে আমার মনে হয়েছে, কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, শিশু-কিশোরদের জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক একটি কমিটি গঠন করা। এই কমিটিতে শিক্ষক, চিকিৎসক, সমাজকর্মী, মনোবিজ্ঞানী, পুলিশ, প্রশাসন একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহণ থাকবে। তারা ওই এলাকার শিশু-কিশোরদের ব্যাপারে তথ্য রাখবেন।

তিনি আরও বলেন, এই সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমানে কিশোর-কিশোরীরা স্মার্টফোনকেন্দ্রিক ইন্টারনেটের সুযোগকে অপব্যবহার করছেন। তাই অন্তত এইচএসসি পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের কাছে স্মার্টফোন না দেওয়া যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিতে হবে।

সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশে আইনের জটিলতা, জনবলের অভাব এবং অবকাঠামোর অভাবে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। কিশোর অপরাধ করলে মোবাইল কোর্ট করা যেত, এখন হাই কোর্ট বলেছে, এটা করা যাবে না। মোবাইল কোর্ট করা যাবে না, নরমাল আদালতে বিচার করা যাবে না, জেলে রাখা যাবে না, রাখব কোথায়? বিচারে পাঠাব কোথায়? তবে কিশোর অপরাধ দমনের জন্য পরিবারকে দায় নিতে হবে। পরিবার থেকেই সুশিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে কিশোররা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ হয় ঘরে বসেই। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমুর বিভিন্ন গ্রুপে বসে বসে পরিকল্পনা করে ‘গ্যাং কালচার’-এর। কোথায় কখন আড্ডা হবে, কতগুলো বাইক/গাড়ি থাকবে, কোন এলাকায় অবস্থান নিতে হবে, এমনকি কোথায় বসে কোন ধরনের মাদক গ্রহণ করবে, তাও ঠিক করে ফেলছে ঘরে বসে এসব গ্রুপে। অভিভাবকরা মোটেও টের পান না এসব পরিকল্পনার, কারণ সবকিছু লুকিয়ে থাকে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ইনবক্সে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়, খুবই নিরাপদে এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে কিশোররা। ফলে ধরন পাল্টে, আগের চেয়েও বেশি সংঘবদ্ধ হয়ে পরিকল্পিতভাবে অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানী জুড়েই এ ধরনের অভিযান চলবে। এ জন্য সবগুলো বিভাগে সাদা পোশাকে ঘুরে ঘুরে খোঁজ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে অযথা কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের সন্তানরা সন্ধ্যার পর যাতে বাইরে না থাকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে অভিভাবকদেরই।

পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র বলছে, রাজধানীতে এখন অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এদের সদস্য সংখ্যা দেড় থেকে দুই হাজার জন। রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুর, বৃহত্তর মিরপুর, পুরান ঢাকার লালবাগ এবং হাজারীবাগ এলাকাতেই মূলত কিশোর গ্যাং ছড়ানো ছিটানো। মারামারি, ছিনতাই, মাদকের কারবার এমনকি হত্যাকান্ডের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা।

সম্প্রতি রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের কয়লাঘাট এলাকায় পায়ে পাড়া দেওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যা করা হয়েছে সিফাত নামে ১২ বছর বয়সী এক শিশুকে। এ ঘটনায় যে ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তাদেরও বয়স ছিল ১০ থেকে শুরু করে ১৪ বছরের মধ্যে।

একাধিক সূত্র বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের মদদ দিচ্ছে এলাকার কথিত বড় ভাইরা, ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। গত বছরের মাঝামাঝিতে রাজধানীর উত্তরা আজমপুর রেললাইনের পাশে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় রক্তাক্ত হয় এক কিশোর। সিসিটিভির আরেকটি চিত্রে দেখা যায়, একই এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের মহড়া। কয়েক বছর আগে উত্তরায় কিশোর গ্যাংয়ের বলি হয় আদনান নামে আরেক কিশোর। উত্তরখানে তুচ্ছ ঘটনায় এক কিশোরকে খুন করে গ্যাং সদস্যরা। এর পরপরই ঘটে আরও কয়েকটি হত্যাকান্ড। এ ছাড়াও তাদের হামলার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, কিশোর অপরাধের পেছনে পরিবার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা রয়েছে। কেউই দায় এড়াতে পারে না। সমাজ পরিবর্তনের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন চর্চার বিষয়টি ভেঙে পড়েছে। যার কারণে সমাজে একটা শূন্য অবস্থা তৈরি হওয়ায় শিশু-কিশোররা নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরের উদ্যোগে রাজধানীর হাতিরঝিল থানার উদ্যোগে একাধিক অভিযান চালিয়ে ৩৮৮ জন কিশোরকে নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়। পরে ১৩৫ জনকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ জন্য প্রতি সপ্তাহে তাদের সংশ্লিষ্ট থানায় হাজিরা দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে কয়েক দফায় বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। সে অনুযায়ী কাজও হয়েছে। এখন হাতিরঝিলের মতো বিনোদন কেন্দ্রসমূহে বখাটেদের উৎপাত বন্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যসব বিনোদন কেন্দ্রে অভিযান চলবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর