সরকারের বিভিন্ন দফতরসহ ১৩টি ক্ষেত্রে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে এর সমাধানে অন্তত ১১০ সুপারিশ পেশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে গত রবিবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে উপস্থাপন করা ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ছাড়া সেবাধর্মী ও কার্যকর আমলাতন্ত্রের জন্য স্থায়ী সিভিল সার্ভিস সংস্কার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে দুদক। এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ২০১৯ সালে দুদকের ৮টি প্রাতিষ্ঠানিক টিমের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে উক্ত খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে, সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তিতে জন হয়রানি হ্রাস পাবে ও সরকারি দফতরগুলোতে অব্যবস্থাপনা অনেকাংশে কমে যাবে। বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাত, ওষুধ শিল্প, সড়কে যানবাহন ব্যবস্থাপনা, নদী দখল, ভূমি রেজিস্ট্রেশন সেবা, ইটভাটা স্থাপন, বিএনসিসি, ওয়াসা, রেলওয়ে, আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাটসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির সম্ভাব্য কিছু উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিকারের জন্য সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণার্থী বাছাই প্রভৃতিতে আদর্শ নীতিমালা অনুসৃত হয় না, ফলে স্বার্থান্বেষী মহল থেকে অর্থ আদায় করা হয় বলে জানা যায়। সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কিছু কর্মচারী একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকার ফলে স্থানীয় দালালদের সমন্বয়ে সংঘবদ্ধ চক্রে পরিণত হয়। সাধারণ রোগীদের অজ্ঞতা ও অসহায়ত্বের সুযোগে তারা বেআইনিভাবে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন ক্রয় কমিটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিরপেক্ষ ও দক্ষ কর্মকর্তা সংযুক্ত না থাকায় সহজেই সরকারি টাকা আত্মসাতের সুযোগ হয়। ক্রয় কমিটির কাজে সরকারের যথাযথ নজরদারি নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয়ভাবে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়। সরকারি হাসপাতালের ওষুধ রোগীদের না দিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মেধা যাচাই না করে অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এক্ষেত্রে দুদকের সুপারিশ হলো সরকারি হাসপাতালে উন্মুক্ত স্থানে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন করা। ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রয় কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা। ইজিপিতে টেন্ডার আহ্বান করা। হাসপাতালগুলোতে সরকারের নির্ধারিত ওষুধের তালিকা ও ডায়াগনসিসের মূল্য তালিকা জনসমক্ষে প্রদর্শন। তিন মাস পর পর চিকিৎসকদের নৈতিকতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন দিবসে প্রতি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যমেলার আয়োজন করা। প্রাইভেট হাসপাতালে ভুল রিপোর্ট ও চিকিৎসা প্রতিরোধে প্রতিটি জেলায় সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে সার্ভিল্যান্স টিম গঠন করা। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর ভেঙে স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর গঠন করা।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দুর্নীতির অন্যতম উৎস হলো ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির মান সনদ গ্রহণ প্রক্রিয়া। এলোপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে ওষুধ প্রশাসনের সরেজমিন পরিদর্শনের কথা থাকলেও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। ফলে নিম্নমানের, নকল ও ভেজাল ওষুধের সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে না। মানহীন ওষুধ উৎপাদনের মূলে রয়েছে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া কাঁচামাল। দেশের প্রায় আড়াই লাখ ফার্মেসির মধ্যে অর্ধেকই থাকে পরিদর্শনের বাইরে। এক্ষেত্রে দুদকের সুপারিশ হলো ওষুধ প্রশাসনের ল্যাবরেটরির ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমেও বিকল্প পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। মান পরীক্ষা না করে ওষুধ বাজারে ছাড়া যাবে না। নিয়মিত ওষুধ কারখানা পরিদর্শন করতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ঘুমের ওষুধ বা ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রি করা যাবে না।সড়কে অবৈধ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল দেশের সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করে দুদক। ফিটনেসবিহীন যানবাহন সড়কে চলতে পারে না দুদক সুপারিশ করেছে। চালকদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা ও তাদের জন্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। চালকদের লাইসেন্স প্রদানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও বেসরকারি পর্যায়ে নিয়োগপত্র প্রদান বাধ্যতামূলক করা। সড়কের যেসব স্থানে সাইন ও সংকেত নেই সেসব স্থানে দ্রুত সাইন ও সংকেত স্থাপন।
বাজারে ভেজাল, নকল ও নিষিদ্ধ পণ্যের সরবরাহে দুদক উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ এতে দেশের জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও ইমেজ ক্ষুণœ হচ্ছে। তাই দুদকের সুপারিশ হলো এ ক্ষেত্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। বন্দরগুলোতে সমন্বিত মনিটরিংয়ের জন্য যৌথ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিতে হবে। নিষিদ্ধ পলিথিনের আগ্রাসন রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। প্রচলিত ভূমি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতির কয়েকটি দুর্বলতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি দুদক সুপারিশ করেছে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি ডিজিটাল ও আধুনিক করতে হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতার জন্য ভূমি জরিপ, ভূমি প্রশাসন ও ভূমি রেজিস্ট্রেশনকে এক ছাতার নিচে আনতে হবে। প্রায় প্রতিটি জেলায় অবৈধ ইটভাটা আছে জানিয়ে দুদক বলেছে ইটভাটা নির্মাণে লাইসেন্স প্রদানের প্রতিটি প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হয়। পরিবেশবান্ধব নয় ও অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করতে হবে। উচ্ছেদকৃত স্থানে বা অন্যস্থানে আর অবৈধ ইটভাটা নির্মাণ করতে দেওয়া যাবে না। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গার্ল গাইড, স্কাউটিং ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে। সার্টিফিকেটে এ খাতের নম্বর যুক্ত করতে হবে। এই সার্টিফিকেট ছাড়া কেউ সরকারি চাকরির যোগ্য হবে না। সরকারি অধিকাংশ সেবা প্রতিষ্ঠানে দালালের দৌরাত্ম্য রয়েছে জানিয়ে এর প্রতিকারে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক নজরদারি বৃদ্ধি, কর্মীদের নাম-পদবিসহ পরিচয়পত্র দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন। ওয়াসায় দুর্নীতির সম্ভাব্য ১১টি খাতের মধ্যে রয়েছে প্রকল্প কাজে দুর্নীতি, অন্তর্বর্তীকালীন পানি সরবরাহ প্রকল্পে দুর্নীতি, ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি। প্রকল্পের দুর্নীতি রোধে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর সমন্বয়ে যৌথ পরিমাপ টিম ও মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে। গণশুনানির আয়োজন করা। আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাটের বিষয়ে বলা হয়েছে কর না বাড়িয়ে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। ব্যক্তি শ্রেণির করদাতার জন্য বিদ্যমান আয়কর বিবরণী পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আয়কর রিটার্ন ফর্মের খসড়া দিয়েছে দুদক। রেলওয়ের দুর্নীতি রোধে সুপারিশের মধ্যে রয়েছে জনবল নিয়োগে বুয়েটের মতো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিতে হবে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় পিপিআর অনুযায়ী পরামর্শক নিয়োগে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা। রেলওয়ে কর্মীদের বাসভবন, অফিস স্থাপনার সম্পত্তি ডিজিটাল ডাটা এন্টির মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করা। কোচ আমদানি নিরুৎসাহিত করে রেলওয়ের নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে কোচ নির্মাণের সক্ষমতা সৃষ্টি করা। একচেটিয়া ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পিপিএ এবং পিপিআর অনুসরণ করা। অডিট কার্যক্রম জোরদার ও অডিট আপত্তি জরুরিভাবে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা।
সততা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি ও বদলি হবে। রেলওয়ের সব কাজ হবে অটোমেশন পদ্ধতিতে। সিভিল সার্ভিস সংস্কারের বিষয়ে যৌক্তিকতা উল্লেখ করার পাশাপাশি এর কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে দাফতরিক কর্মপদ্ধতি নতুন করে নির্ধারণ, জনসেবার মানোন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক ও পদ্ধতিগত উদারীকরণ। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণ, আন্তক্যাডার বৈষম্যদূরীকরণ এবং নির্বাহী বিভাগের ওপর সংসদীয় তদারকি বৃদ্ধি। এ ছাড়া সিভিল সার্ভিসের মৌলিক বিষয়ে সরকারকে নীতিগত পরামর্শ প্রদান। সিভিল সার্ভিসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, গবেষণা পরিচালনা। বিবিধ সুপারিশের মধ্যে রয়েছে থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে সিভিল সার্ভিসের পুলিশ ক্যাডার থেকে সহকারী পুলিশ সুপার বা অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব প্রদান করা। নবম থেকে তদূর্ধ্ব গ্রেডে পদোন্নতির জন্য সিলেবাসের আওতায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ উল্লেখযোগ্য।