বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনিদের নাম ছিল রেজিস্টার বইয়ে

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনিদের নাম ছিল রেজিস্টার বইয়ে

কারও নিষেধ শুনছিলেন না কান্তা। স্বামীর সঙ্গে ভারত ঘুরতে যাবেনই। বাবা, বোনসহ পাড়া-পড়শি প্র্রত্যেকেই না করছিলেন। তারা বলছিলেন, তোর স্বামীর স্বভাব-চরিত্র ভালো ঠেকছে না। কিন্তু কান্তা শুনছিলেন না। ভাবছিলেন, হাজার হোক স্বামী তো। ভুলভাল যা আছে সবই ঠিক করে নেবেন। এটা তার কাছে কোনো বিষয় নয়। স্বামীর সঙ্গে কান্তা ভারতের উদ্দেশে নিজের বাসা ছাড়লেন। এরপর তার কোনো খোঁজ নেই। কোথাও নেই কান্তা। তাকে হত্যা করা হয়েছে নাকি বন্দী, কিছুই জানতে পারে না কান্তার পরিবার। থানা-পুলিশ করেও লাভ হয়নি। কান্তা বেঁচে আছেন নাকি মৃত, এ প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠে পরিবারের কাছে। নিখোঁজের দুই বছর পর একটি আবাসিক হোটেলের রেজিস্টার বই খুলে দিয়েছিল কান্তা রহস্য। পুলিশ জানতে পারে কান্তা আর বেঁচে নেই। খুন হয়েছেন। খুনিও গ্রেফতার হন। নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার সোহরাব হোসেন রতনের মেয়ে মার্জিয়া আক্তার কান্তা। আশুলিয়ায় বিউটি পারলারের ব্যবসা করতেন। সেখানে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার শহিদুল ইসলাম সাগরের সঙ্গে পরিচয়। পরে বিয়ে। বিয়ের কিছু দিন পর কান্তা জানতে পারেন সাগরের আরও এক স্ত্রী রয়েছেন। বিষয়টি গোপন রেখে তাকে বিয়ে করায় মেনে নিতে পারেননি কান্তা। এ নিয়ে ব্যক্তিগত ফেসবুক স্ট্যাটাসে সাগরকে প্রতারক ও লম্পট আখ্যা দেন। বিষয়টি সাগরের নজরে পড়ে। তিনি কান্তার কাছে মাফ চান। একপর্যায়ে ভারতে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে কান্তার মন জয় করেন। সবার বাধা অগ্রাহ্য করে ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কান্তা ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে যান। এর পর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ নেই। এদিকে কান্তার খোঁজ না পেয়ে চার মাস পর কান্তার বাবা কুড়িগ্রামের রৌমারীতে যান সাগরদের বাড়ি। সাগরের পরিবার কান্তার বাবাকে জানায়, কান্তা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। সাগরকেও তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। উল্টো তারা কান্তার বাবাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে সেখান থেকে বিদেয় করেন। কান্তার বাবা স্থানীয় থানা পুলিশকে জানান। সাধারণ ডায়েরি করতে চান। কিন্তু ডায়েরি নেয়নি পুলিশ। তিনি ফিরেন আসে রৌমারী থেকে।

এরই মধ্যে আশুলিয়ায় পারলার বন্ধ থাকায় দোকানের মালিকের ভাড়া বাকি পড়ে থাকে। দোকান মালিক কান্তার পরিবারকে জানান দোকান ছেড়ে দিতে। কান্তার বড় বোন পারলারের মালামাল গোছাতে গিয়ে একটি ডায়েরি খুঁজে পান। সে ডায়েরির একটি পাতায় বেশ কয়েকটি ফোন নম্বর পান তিনি। নম্বরগুলো সাগরের। কান্তার বোন নম্বরগুলোয় কল করেন। একটি নম্বর খোলা পাওয়া যায়। রিং হতেই অন্য প্রান্তে ফোন ধরেন সাগর। কান্তার বোন সাগরের কণ্ঠ পেয়ে কান্না করতে থাকেন। কান্তার খবর জানতে চান। সাগর তাকে জানান, ভারতের শিলিগুড়ি কারাগারে আটক আছেন কান্তা। শিলিগুড়ির একটি বাসে তাদের পেছনের সিটে পুলিশ ইয়াবা পায়। মালিক না থাকায় তাদের দুজনকে আটক করে। দুজনকে দুটি কারাগারে আটকে রাখা হয়। তিনি জামিনে বেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন টাকা নিতে। কান্তাকে ছাড়িয়ে আনতে ফের ভারত যাবেন। এমন কথা বলেই ফোন কেটে দেন সাগর। সাগরের ওই নম্বর আর খোলা পাওয়া যায়নি। ঘটনার প্রায় এক বছর পর ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি কান্তার বাবা সোহরাব হোসেন রতন বাদী হয়ে হত্যাপূর্বক লাশ গুমের একটি মামলা করেন। নরসিংদী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে করা ওই মামলায় কান্তার স্বামী সাগরসহ তার পরিবারের পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়। আদালত বেলাবো থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। সাগরের দুই ভাইকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে জেরা করা হয়। কিন্তু কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। রহস্যের কিনারা করতে পারে না পুলিশ। এরপর মামলার তদন্তভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কিন্তু পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হয়ে গেলে তদন্তে ছেদ পড়ে। তত দিনে পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই বছর। ইতিমধ্যে সাগর মিথ্যা কাগজপত্র জমা দিয়ে হাই কোর্ট থেকে আগাম জামিন নেন। পরে হাজির হলে তার জামিন বাতিল করে দেয় আদালত। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন পিবিআই পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি তদন্ত শুরু করেন। সাগরের বিষয়ে তথ্য নিয়ে আদালতে জমা দিয়ে রিমান্ডের আবেদন জানান। সাগরকে রিমান্ডে নেন পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান। এর আগে তদন্তের শুরুতেই এই কর্মকর্তা তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নেন। জানতে পারেন সর্বশেষ তাদের অবস্থান ছিল শরীয়তপুর শহরে। পুলিশের টিম শরীয়তপুর যায়। সেখানকার হোটেলগুলোয় খোঁজ নিতে থাকে। রেজিস্টার বইয়ে দেখতে থাকে সাগর আর কান্তা নামে কোনো অতিথি ছিলেন কিনা। ২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুরে আবাসিক হোটেল নূর ইন্টারন্যাশনালের রেজিস্টার বইয়ে সাগর আর কান্তার নাম পাওয়া যায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে কান্তার বাবাও ছিলেন। সাগর আর কান্তার নামের সঙ্গে মামুন নামে আরও এক ব্যক্তির নাম ছিল। সেই মামুনের নাম দেখার সঙ্গে সঙ্গে কান্তার বাবা বলে ওঠেন, ওকে ধরলেই সব পাওয়া যাবে। রিমান্ডে নিয়ে সাগরকে জেরা করে পুলিশ। সাগর কিছুই বলতে চাচ্ছিলেন না। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কেন শরীয়তপুর গিয়েছিলেন। এ কথা শুনেই সাগর বুঝতে পারেন কোনো কিছু আর গোপন করা যাবে না। তখন সাগর বলেন, তারা হোটেলে উঠেছিলেন ঠিকই কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখেন রুমে কান্তা নেই। মামুনও নেই। পুলিশ তখন নিশ্চিত হয়, কান্তাকে তারা খুন করেছেন। কিন্তু প্রমাণের জন্য মামুনকে দরকার। পুলিশ মামুনের খোঁজে নামে। রৌমারী থেকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় মামুনকে। পুলিশ এবার মামুনকে জেরা করে। কিন্তু বেশি সময় লাগেনি। মামুন বলে দেন, তিনি আর সাগর মিলে কান্তাকে খুন করেছেন কুয়াকাটার একটি আবাসিক হোটেলে। ওই হোটেলেই লাশ ফেলে তারা লাপাত্তা হন। পুলিশ কুয়াকাটা পুলিশের কাছে খবর নেয়। কিন্তু সেখানে সেই সময়ে কোনো লাশ উদ্ধারের ঘটনা নেই বলে পুলিশ জানায়। তদন্তকারী সংস্থা পড়ল আরেক বিপদে। তাহলে কি মামুনের দেওয়া তথ্য মিথ্যা? এমন প্রশ্ন নিয়েই পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা ছুটলেন কুয়াকাটায়। গেলেন সেই হোটেলে। পিবিআই জানতে পারে আশুলিয়া থেকে সাগর-কান্তা দম্পতি প্রথমে শরীয়তপুরে আবাসিক হোটেল নূর ইন্টারন্যাশনালে গিয়ে রাত কাটান। সেখানে সাগরের মামাতো ভাই মামুন তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। পরদিন ২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিকালে কুয়াকাটায় গিয়ে আবাসিক হোটেল আল-মদিনার একটি কক্ষে ওঠেন। পরদিন সাগর আর মামুন কান্তাকে হত্যা করে লাশ ফেলে তালা ঝুলিয়ে বাইরে চলে যান। ওই হোটেল কক্ষে তালা ঝুলতে দেখে হোটেল কর্তৃপক্ষের সন্দহ হয়। তারা পুলিশে খবর দেন। পুলিশ গিয়ে কান্তার ব্যবহৃত জামাকাপড় জব্দ করে নিয়ে গেলেও খাটের নিচে লাশের বিষয়টি তাদের নজরে আসেনি। এর দুই দিন পর (২৫ সেপ্টেম্বর) ওই কক্ষ থেকে দুর্গন্ধ বের হতে থাকলে হোটেল ম্যানেজার আমির ও বয় সাইফুলের নজরে আসে বিষয়টি। তারা হোটেল মালিক দেলোয়ারকে ঘটনা জানালে দেলোয়ার, তার ছোট ভাই আনোয়ার, ম্যানেজার আমির ও বয় সাইফুল চারজন মিলে লাশ গুমের সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওইদিন রাতেই ১১টার দিকে লাশ বস্তায় ভরে মোটরসাইকেলের পেছনে তুলে দেলোয়ার ও আনোয়ার কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের পশ্চিম দিকের লেম্বুচরে নিয়ে যান। সেখানে গলাসমান সমুদ্রের পানিতে নেমে লাশ ভাসিয়ে দিয়ে দুই ভাই হোটেলে চলে আসেন। পিবিআই জানায়, কান্তার নিখোঁজ রহস্য দুই বছর পর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে উদঘাটিত হয়। স্বামী ও তার এক সহযোগী কান্তাকে নিয়ে কুয়াকাটার ওই হোটেলে পর্যটক হিসেবে ওঠার পর তাকে হত্যা করে পলিথিনে লাশ মুড়িয়ে খাটের নিচে রেখে পালিয়ে যান। বিষয়টি হোটেল কর্তৃপক্ষের নজরে এলে ঝামেলা এড়াতে তারা রাতের অন্ধকারে কান্তার লাশ বস্তায় ভরে মোটরসাইলের পেছনে তুলে নিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দেন। দুই বছর হতে চললেও এত দিন ওই হোটেল কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং খুনিরাও ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। শরীয়তপুরে এক রাত কাটানো হোটেলের রেজিস্টার বই খুলে দিয়েছে কান্তা খুনের রহস্য।

সর্বশেষ খবর