শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

রক্তের দাগের শেষ মাথায় খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

রক্তের দাগের শেষ মাথায় খুনি

ঘরের আসবাব সব তছনছ। ঘরের প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে খোলা ল্যাট্রিনের রিংয়ে পা উপুড় করা অবস্থায় পাওয়া যায় ওই বসতঘরের বাসিন্দা নারীর লাশ। নিহত ওই নারীর নাম জুলেখা বেগম (৪৫)। পুলিশ ও প্রতিবেশীদের ধারণা, ঘরের কোনো কিছু লুট করে নিতে ওই নারীকে খুন করে লাশ গুম করতেই ফেলা হয়েছে ল্যাট্রিনে। লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশের নজরে পড়ে রক্তের দাগ।  ল্যাট্রিনের পাশে দেখা যায়, ছোপ ছোপ রক্ত। উদ্ধার করা লাশের গা থেকে কোনো রক্ত ঝরেনি। তাহলে এই রক্ত কার? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পুলিশ মাঠে নামে। একপর্যায়ে রক্তের দাগ দেখে খুনির গন্তব্য শনাক্ত হয়। রক্তের শেষ মাথায় থাকা খুনি ধরা পড়ে। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁওয়ের মোল্লাটিলা এলাকায় ওই নারীকে খুনের ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি গত বছরের ১৩ আগস্টের। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়া জুলেখা প্রায় চার মাস ধরে দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছিলেন মোল্লাটিলার একটি ভাড়া বাসায়। দুই ছেলে ওয়ার্কশপে কাজ করেন। প্রতিদিন সকালে কাজে যান, কাজ শেষে ঘরে ফেরেন সন্ধ্যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে মায়ের খোঁজ তারা পাচ্ছিলেন না। ঘরের ভিতর তছনছ অবস্থা দেখে তাদের বুক কাঁপে। প্রতিবেশীদের নিয়ে মাকে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে ঘর থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে একটি খোলা ল্যাট্রিনের মধ্যে মায়ের লাশ খুঁজে পান। ফেঞ্চুগঞ্জ থানার পুলিশকে খবর দেন। রাত ১১টার দিকে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। ফেঞ্চুগঞ্জ থানা পুলিশ জানায়, জুলেখার গলায় গামছা পেঁচানোর চিহ্ন ছিল। এতে ধারণা করা হয়, তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। তবে শরীরে কোনো জখমের চিহ্ন ছিল না। কিন্তু ল্যাট্রিনের পাশে ছোপ ছোপ রক্ত দেখে সন্দেহ হয়। রাত ১১টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত রক্তের দাগ দেখে অজ্ঞাতপরিচয় খুনির গন্তব্য শনাক্ত করা হয়। পুলিশ মোল্লাটিলা এলাকার একটি গরুর খামারে গিয়ে রোকন ওরফে কালু (২০) নামের এক যুবকের বাঁ পায়ে কাচের কাটার জখম দেখতে পায়। পরে কালুর এক সহযোগী ইন্দ্র (২১) ও ১৪ বছর বয়সী একজনসহ তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনজন স্বীকার করেন জুলেখা হত্যার ঘটনা। জুলেখা তার দুই ছেলের রোজগার থেকে কিছু টাকা জমিয়ে রাখতেন। এই টাকা দিয়ে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। ওই টাকা জমানোর বিষয়টি কালু তার এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। সেই সন্ধ্যার পর টাকা চুরি করতে জুলেখার ঘরে ঢোকেন তিনজন। এ সময় জুলেখা বাধা দিলে তাকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে লাশ ল্যাট্রিনে ফেলে দেন তারা। লাশ ফেলার সময় কালুর বাঁ পায়ে কাচের টুকরায় কেটে যায়। কাটা পা থেকে রক্ত ঝরছিল, যা দেখে পুলিশ খুনি শনাক্ত করেছে। ফেঞ্চুগঞ্জ থানার পরিদর্শক মো. খালেদ চৌধুরী রাত ১১টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত একটানা ১১ ঘণ্টা ওই ঘটনার পেছনে ছিলেন। ‘ক্লুলেস’ হত্যাকান্ডটি শেষ পর্যন্ত রক্তের দাগ দেখে খুুনিকে শনাক্ত করা হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে আসামি করে মামলা করেছেন জুলেখার বড় ছেলে মো. রুমান আহমদ (২১)। মামলায় তিনজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। জুলেখার জমানো ছিল ৮ হাজার ৮৬৮ টাকা। সেই টাকা তিনজনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। জুলেখার বড় ছেলে মো. রুমান আহমদ। ছোট এক ভাইকে নিয়ে ওয়ার্কশপে কাজ করেন। প্রায় পাঁচ মাস আগে তাদের বাবা মাকে তালাক দেন। এরপর থেকে তারা দুই ভাই মাকে নিয়ে মোল্লাটিলা এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছিলেন। কাজের জন্য প্রতিদিন তারা দুই ভাই সকালে ঘর থেকে বের হতেন, ফিরতেন সন্ধ্যার পর। ঘরে ফিরে দৈনিক রোজগারের টাকা মায়ের হাতে তুলে দিতেন। রুমানের ভাষায়, ‘ওই দিনও ৩০০ ট্যাকা মার হাতও দিবার লাগি গেছি। গিয়া দেখি মা নাই। এরপর লাশ পাইলাম। জমাইল ট্যাখা বিষয়টা কালু জানছিল। এই জানাটাই শেষ পর্যন্ত কাল অইল। আমরা মারে হারাইলাম।’

সর্বশেষ খবর