রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভিসিরা কেন বিতর্কে

আকতারুজ্জামান

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভিসিরা কেন বিতর্কে

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ঘিরে বিতর্ক থেমে নেই। দুর্নীতি, অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, ক্যাম্পাসে অবস্থান না করাসহ অনেক অভিযোগ এসব উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে বলে ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে। এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে আনা নানা অভিযোগের সত্যতা পেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত ডিসেম্বরে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে উপাচার্যকে। মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়- নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান তার মেয়ে সানজানা সোবহানকে ও জামাতা এ টি এম শাহেদ পারভেজকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এমন স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। এসব নিয়োগ কেন বাতিল করা হবে না সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে উপাচার্যকে। এ ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে ডুপ্লেক্স বাড়ি দখলে রাখায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এই টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতেও বলা হয় উপাচার্যকে। উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ পরিবেশনের কারণে বিভিন্ন সময় তার ‘অনুগত বাহিনী’ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জিডি ও মামলা করারও অভিযোগ রয়েছে। এক শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী গত ২০১৯ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে অংশ নিতে নির্ধারিত ফি জমা দিলেও সমাবর্তনের আগের দিন তার সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানানো হয় তার মূল সনদ, গাউন ও আমন্ত্রণপত্র আসেনি। তাকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ক্যাম্পাসে সাংবাদিক নির্যাতনকারী হিসেবেও চিহ্নিত।

অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্যাম্পাসে উপস্থিত না থাকাসহ অনেক অভিযোগ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে। গত ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু পরিষদের শিক্ষক নেতারা উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিকার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের নিয়োগে স্থগিতাদেশ চেয়ে চিঠি দেয় শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব বরাবর। ক্যাম্পাসে না গিয়ে ঢাকায় লিয়াজোঁ অফিস খুলে তিনি দুর্নীতি-অনিয়ম করছেন বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। চিঠিতে আরও বলা হয়, গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত উপাচার্য তার দায়িত্বের ১ হাজার ২৬৩ দিনের মধ্যে ১ হাজার ২৭ দিনই ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিলেন। উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের তদন্তের অংশ হিসেবে সম্প্রতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করেছে ইউজিসি প্রতিনিধি দল। শিগগিরই এ প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম প্রতিবেদককে বলেন, উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত দুই পক্ষের বক্তব্য জানতে চাই আমরা। উপাচার্যদের শেষ মেয়াদে এসব অভিযোগ বেশি পাওয়া যায়। টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। উপাচার্যের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষামন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অভিযোগ আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে ইউজিসি। অভিযোগ রয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে ইচ্ছামতো নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য ড. মো. আলাউদ্দিন। নিম্নমান সহকারী ও উচ্চমান সহকারী পদে কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ১০ জন প্রার্থীকে একই দিনে মৌখিক পরীক্ষার কার্ড বিতরণ করে একই দিনে পরীক্ষা নিয়ে তাদের একই দিনে নিয়োগ শেষ করেছেন। এই প্রার্থীরা ওই একই দিন যোগদানও করেছেন। অভিযোগ রয়েছে- উপাচার্য মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব প্রার্থীকে তড়িঘড়ি করে নিয়োগ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এ উপাচার্যের  মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ২৯ জুলাই। দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তিনি গণনিয়োগের ছক আঁকছেন বলে শিক্ষক সমিতির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান। সম্প্রতি তিনি ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই মাস্টাররোল ও অ্যাডহকে নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের নিয়োগ স্থায়ী করার পাঁয়তারা করছেন তিনি।

নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত চলছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শহীদুর রহমান খানের বিরুদ্ধেও। নিয়োগে বাণিজ্য ছাড়াও যোগ্যতা শিথিল করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরেজমিন তদন্ত করেছে ইউজিসির প্রতিনিধি দল।

অধ্যাপক ড. এম রোস্তম আলী পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর থেকেই একের পর এক আর্থিক, একাডেমিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম-দুর্নীতি করে চলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্যাম্পাসে সার্বক্ষণিক উপস্থিত না থাকা, গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবসে ক্যাম্পাসে না থাকাসহ আরও অনেক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করে ড. মো. আবদুল আলীম নামে এক শিক্ষককে উপাচার্য হয়রানি, মানসিক নির্যাতন ও চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগী শিক্ষক শিক্ষামন্ত্রী বরাবর এমন অভিযোগ করলে অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত চলমান রেখেছে ইউজিসি। ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ প্রতিবেদককে বলেন, উপাচার্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যায়। শিক্ষকদের মধ্যে স্বজনপ্রীতি থাকলে, নৈতিক অবস্থান শক্ত না হলে, রাজনৈতিক চাপ সহ্য করার সৎ সাহস না থাকলে এসব সমস্যার সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, উপাচার্যরা সততা, নৈতিকতা ও সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন, তারা আইন মেনে চলবেন- এমনটাই প্রত্যাশা। উপাচার্যদের নিয়ে তদন্ত করতে আমরাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। কারণ, উপাচার্য একটি সম্মানজনক পদ। এই পদে যেসব সম্মানিত ব্যক্তি থাকবেন তাদের ব্যাপারে অভিযোগ আসা যেমন অবাঞ্ছনীয়, তেমনি তদন্ত করাও সুখকর বা শোভনীয় নয়। উপাচার্যরা যেসব শর্ত সাপেক্ষে নিয়োগ পান সেসব তো মানতে হবে। উপাচার্য যদি ক্যাম্পাসেই না থাকেন তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সমস্যার সমাধান হবে কী করে?

সর্বশেষ খবর