সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

টিকা নিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সেনাপ্রধান

ডায়াবেটিস রোগীর ঝুঁকি কমাবে টিকা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

টিকা নিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সেনাপ্রধান

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ গতকাল সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ঢাকায় করোনাভাইরাসের টিকা নেন -আইএসপিআর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কেন্দ্রে ছেলের সঙ্গে টিকা নিতে এসেছিলেন পরীবাগের বাসিন্দা  রেহানা বেগম (৫৮)। টিকা নিয়ে বিশ্রাম করছিলেন তিনি। তার ছেলে রায়হান সিদ্দিকী বলেন, আমার মা প্রায় ১৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস সমস্যায় ভুগছেন। নিয়মিত হাঁটা, সময়মতো ঘুম এবং পরিমিত খাওয়ার কারণে তার ডায়াবেটিস মোটামুটি নিয়ন্ত্রণেই থাকত। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে মাকে আর হাঁটতে যেতে দিতাম না। কারণ আমাদের আত্মীয়ের মধ্যে একজন ডায়াবেটিস রোগী করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিসের কারণে চিকিৎসায় সমস্যা হচ্ছিল। এ জন্য মাকে বলেছিলাম বাসাতেই হালকা ব্যায়াম করতে। কিন্তু ডায়াবেটিসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছিল। তাই দেশে টিকাদান শুরু হলেই ডাক্তারের পরামর্শে নিবন্ধন করে মাকে টিকা দিতে নিয়ে এসেছি। এখন আমাদের পাশাপাশি মাও সাহস পাচ্ছেন। শুধু রেহানা বেগম নন গতকাল বেলা ১১টায় বিএসএমএমইউ কেন্দ্রে টিকা নিয়ে অপেক্ষমাণ ৩০ জন ব্যক্তির মধ্যে ১১ জন ডায়াবেটিস সমস্যায় ভুগছেন বলে জানান। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের বয়স ৪২ থেকে ৬৫-এর মধ্যে। দেশে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে ডায়াবেটিসের রোগী। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ৮৩ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ মানুষ জানেন না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতায় মারা যাচ্ছেন।

রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসায়ও যোগ হয়েছে নানা মাত্রা। স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এবং চিকিৎসকদের সুবিধার্থে মোবাইল ফোনভিত্তিক একটি অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) চালু করা হয়েছে। ‘ডায়াবেটিক জার্নি’ নামের এই অ্যাপ মূলত ডায়াবেটিস চিকিৎসা-সহায়িকা। নতুন গাইডলাইনের ওপর ভিত্তি করে অ্যাপটি তৈরি করেছে নভো নরডিস্ক এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস)। নভো নরডিস্কের মার্কেট অ্যাকসেস প্রজেক্ট ম্যানেজার নাজমুল হাসান মাহমুদ বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৫০০ জনের বেশি চিকিৎসক ‘ডায়াবেটিক জার্নি’ অ্যাপ ডাউনলোড করেছেন।’ প্রাণঘাতী এই রোগ ডেকে আনে অন্য রোগকে বাড়িয়ে দেয় জটিলতা। দেশে করোনা আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ডায়াবেটিস রোগী বলে একটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডির যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ার-এর জার্নালে ‘ডায়াবেটিস অ্যান্ড মেটাবলিক সিনড্রোম : ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউস’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের চারটি কভিড হাসপাতালে এপ্রিল থেকে জুন মাসে ভর্তি হওয়া রোগীদের ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান। আন্তর্জাতিকভাবেও ডায়াবেটিসকে করোনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে কভিড-১৯ আক্রান্তদের মাঝে ২০ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১১ শতাংশ এবং চীনে ১০ শতাংশ করোনা রোগীর ডায়াবেটিস আছে। পৃথিবীতে প্রতি ১০ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলে যে কোনো জীবাণুর সঙ্গে শরীরের লড়াই করার ক্ষমতা কমে যায়। তাই এই ঝুঁকি কমাতে সচেতনতার পাশাপাশি টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, ‘ডায়াবেটিস একটা মহামারী, করোনাও মহামারী। অন্য কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাদের চেয়ে ডায়াবেটিস রোগীর জটিলতার ঝুঁকি অনেক বেশি। এ জন্য যারা ইতিমধ্যে ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাদের উচিত দ্রুত করোনার টিকা নেওয়া। এটা তাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।’ গতকাল সারা দেশে টিকা নিয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৫৩ জন। এর মধ্যে রাজধানীতে ২২ হাজার ৯৮২ জন। যার মধ্যে বিএসএমএমইউতে ১ হাজার ৩২৪ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৯৯০ জন, সংসদ সচিবালয় ক্লিনিকে ১৬০ জন, মোহাম্মদপুর ফারটিলিটি সেন্টার ৫০০ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪২০ জন টিকা নিয়েছেন। ঢাকা বিভাগে ৪৫ হাজার ৯১৪ জন, ময়মনসিংহে ৭ হাজার ৩৫৭ জন, চট্টগ্রামে ৩৯ হাজার ৭০৩ জন, রাজশাহীতে ১৮ হাজার ৯৬৫ জন, রংপুরে ১৫ হাজার ২১৮ জন, খুলনায় ১৯ হাজার ৮০২ জন, বরিশালে ৯ হাজার ১৯৮ জন, সিলেটে টিকা নিয়েছেন ১৩ হাজার ১৯৬ জন। সারা দেশে করোনা টিকা নিতে নিবন্ধন করেছেন ১৭ লাখ ৪৬ হাজার জন।

করোনাভাইরাসের টিকা নিলেন স্পিকার : জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ শেষে বলেছেন, ‘ভ্যাকসিনটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। মানুষের জীবন রক্ষার্থে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। সবারই এই ভ্যাক্সিন গ্রহণ করা জরুরি’। দেশব্যাপী গণ-টিকাদান কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদের মেডিকেল সেন্টারে গতকাল তিনি নিজে করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ করেন। এ সময় জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।

করোনাভাইরাসের টিকা নিলেন সেনাবাহিনী প্রধান : সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে গতকাল প্রথম কর্মদিবসেই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)- ঢাকায় করোনাভাইরাসের টিকা নিলেন। টিকা নেওয়া শেষে তিনি সবাইকে করোনাভাইরাসের টিকা নিতে আহ্বান জানান।

আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, দেশের জনসাধারণ তথা সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার সুব্যবস্থা করায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিও জানান। গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচির আওতায় সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশে দেশের সব সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। টিকা প্রদান শুরুর প্রথম ধাপে গতকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৬টি টিকাদান কেন্দ্রে ১৮ হাজার ২৬৯ জন কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গসহ অন্য অসামরিক ব্যক্তিবর্গকে টিকা দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর