সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ধারদেনা পরিশোধের চাপে সরকার

মানিক মুনতাসির

ধারদেনা পরিশোধের চাপে সরকার

রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে সরকার। সঙ্গে যোগ হয়েছে আগের অর্থবছরগুলোর ঋণ। আবার এ ঋণ পরিশোধও করতে হচ্ছে। করোনা মহামারীর কারণে পরিচালন ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে সরকারের ভিতরে দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিন বছর আগে নতুন করে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সংকটও সরকারের অনুন্নয়ন ব্যয়কে উসকে দিয়েছে দিন দিন। এর সঙ্গে গত বছর যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারীর ব্যয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় চাহিদা মেটাতে সরকারকে দেশি-বিদেশি ঋণ নিতে হচ্ছে অতিরিক্ত পরিমাণে। যার ফলে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় ঋণ পরিশোধের চাপ খানিকটা বেশি বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধের এ চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। আগামী বাজেট প্রণয়নের প্রস্তুতি পর্বের সভাগুলোতেও এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট একটি পুরনো ইস্যু। এটি খুব সহসাই সমাধান হবে মনে হয় না। আবার গত বছর শুরু হওয়া করোনা মহামারীর সংকটও বেশ দীর্ঘই হচ্ছে। এসব সংকট তো সরকারের রাজস্ব আদায়ের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। অবশ্য সারা বিশ্বই এখন চাপের মধ্যে রয়েছে। যার ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। আবার উন্নয়ন ব্যয়ও বাড়ছে। কিন্তু উন্নয়ন ব্যয়ের যে ধারা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। কেননা এখানে প্রকল্প ব্যয় নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্ন আছে। কোনো কোনো প্রকল্প অতিমূল্যায়িত করা হয়। আবার কখনো কখনো অদক্ষমতার কারণেও প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে সরকারের ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে বেশি পরিমাণে ঋণ করতে হয়। যার দরুন ঋণের সুদ পরিশোধ করাটা একটা নিয়ম মাত্র।’

এখান থেকে বেরোতে হলে সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি বাজেট ব্যয়ের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিকে গুরুত্ব দিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আর এ বিশাল ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক এ দুই উৎস থেকে ঋণ করছে। এ বছর শুধু ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে এর সিংহভাগই নিয়ে ফেলেছে সরকার। সূত্র জানান, আগামী তিন বছরে ঋণের সুদ পরিশোধে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে সরকার তা দিয়ে অন্তত সাতটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। এ ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে মূলত সরকারের পরিচালন ব্যয় এবং বাজেট ঘাটতি। একই সঙ্গে প্রতি বছরই সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যয় হবে সরকারের পরিচালন খাতে। যার পরিমাণ ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। এদিকে চলতি অর্থবছর শেষে এবং আগামী অর্থবছরের শুরুতেই সরকারের বাজেট ঘাটতি ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ। এ ঘাটতি মেটাতে সরকারকে বেশি পরিমাণে ঋণ করতে হচ্ছে। ফলে এ ঋণের সুদও পরিশোধ করতে হচ্ছে বেশি পরিমাণে। যার একটা নেতিবাচক চাপ পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। সূত্র জানান, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ চলতি অর্থবছর (২০২০-২১) সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ৬৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আসছে (২০২১-২২) বছরে পরিশোধ করতে হবে ৭৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং একইভাবে তার পরের অর্থবছর (২০২২-২৩) এ খাতে সরকারের ব্যয় হবে ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। যা মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (২০২০-২১ থেকে ২০২২-২৩) প্রকাশ করা হয়েছে। সে হিসাব অনুযায়ী সরকার তিন বছর ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করবে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। যা অন্তত সাতটি পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের সমান। পদ্মা সেতুর সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।

সর্বশেষ খবর