শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনির বালিশে খুনের চিহ্ন

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনির বালিশে খুনের চিহ্ন

বাসার ছাদে কবুতরের বাসা। প্রতিদিন সকালে খাবার দেওয়া হয়। সেদিনও খাবার দিতে পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠছিলেন। তিন তলা পর্যন্ত উঠেই তিনি আঁতকে ওঠেন। সিঁড়ির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে এক নারী। এই কে তুমি? কথা বল না ক্যান? নাহ, কোনো জবাব নেই। এবার মহিলা ভয় পান। চিৎকার করে লোকজন ডাকতে থাকেন। বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ারা এসে ভিড় করেন। তারা পড়ে থাকা নারীকে আলতোভাবে ধাক্কা দেন। কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ নেই। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ আসে। তারা নিশ্চিত করে জীবিত নেই। নারীটি মৃত। হাতে রক্তের দাগ। ঘটনাটি চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানার কলসি দিঘীর পাড়ের  বাদামতলার ঘটনা। হাজী নুরুল হক সওদাগরের বাড়ির তৃতীয় তলায় ছাদে ওঠার সিঁড়ি থেকে ওই নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৯ সালের অক্টোবরের ঘটনা এটি। পুলিশের ধারণা হয়, ওই নারীকে অন্য কোথাও শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশ সিঁড়িতে ফেলে রেখে যায় খুনিরা। এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বন্দর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ বিপদে পড়ে যায়। তারা কোনোভাবেই হত্যার ক্লু খুঁজে পাচ্ছিল না। ওই ভবনের বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু হত্যা সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্যই তারা পায় না। পুলিশ ভেবে পায় না, সিঁড়িতে কীভাবে একজন নারীকে হত্যা করা হতে পারে। অন্য কোথাও হত্যা করলেও তো লাশ বয়ে আনতে হবে সিঁড়িতে। কীভাবে সম্ভব হবে? এমন সব প্রশ্ন যখন পুলিশকে ভাবিয়ে তুলছিল, ঠিক তখনই পুলিশের একজন কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিটা বাসায় তল্লাশি চালানোর। ওই কর্মকর্তার বদ্ধমূল ধারণা, ভবনের কেউ না কেউ এই খুনে জড়িত। আর জড়িত থাকলে খুনির বাসাতেই কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। একপর্যায়ে ভবনের যারা বাসিন্দা আছেন তাদের সবার বাসায় তল্লাশি শুরু করা হয়। নিচ তলায় বাড়িওয়ালার বাসা। সেখানে তল্লাশির পর দোতলায় ভাড়াটিয়ার বাসায় তল্লাশি চলে। পুলিশ খুন সংক্রান্ত কোনো সূত্র খুঁজে পায় না। বাড়ির মালিকের এক ছেলের নাম ফারুক। তিনি স্ত্রী, সন্তান নিয়ে থাকেন তিন তলায়। পুলিশ তার বাসাতেও তল্লাশি চালায়। শোয়ার ঘরে তল্লাশি চালাতে গিয়ে কর্মকর্তার চোখে পড়ে বিছানার ওপর একটি বালিশের দিকে। রক্তের দাগ। কয়েক ফোঁটা রক্তের দাগ লাগানো রয়েছে বালিশের কভারে। এতেই কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। নিহত নারীর হাতেও তারা রক্তের দাগ পেয়েছিলেন। বালিশের সেই সূত্র ধরে ফারুককে পুলিশ জেরা করে। একপর্যায়ে ফারুক পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আলমগীর ও রাশেদকে  গ্রেফতার করে পুলিশ। ফারুকের দেওয়া তথ্যে পুলিশ যা জানতে পারে, তা হলো-খুন হওয়া নারী একজন যৌনকর্মী। লাশ উদ্ধারের আগেরদিন ফারুক তার স্ত্রী ও মেয়েকে শ্বশুরের বাসায় রেখে নিজের বাসায় ফিরছিলেন। বাসার কাছাকাছি স্থানে এসে দেখতে পান, তার বন্ধু রাশেদ দাঁড়িয়ে। সঙ্গে একজন নারী। রাশেদ ওই নারীকে নিয়ে ফারুকের বাসায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু ফারুক প্রথমে অসম্মতি জানায়। অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফারুক তার বাবার ফ্ল্যাট নিচতলায় চলে যান। সেখানে ভাত খেয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনতলায় নিজ বাসায় যাওয়ার সময় আবারও দেখেন রাশেদ ওই নারী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন ফারুক তাদের ডেকে নিজের বাসা তিন তলার ফ্ল্যাটে নিয়ে যান। বাসায় যাওয়ার পর রাশেদ তার আরেক বন্ধু আলমগীরকে সেখানে ডেকে আনেন। আলমগীরের সঙ্গে আরও একজন ফারুকের বাসায় আসেন। ফারুক তাকে চিনতেন না। রাতে রাশেদ, আলমগীর ও ফারুক মিলে ওই নারীর সঙ্গে রাত কাটান। ভোর বেলা ওই নারী তাদের কাছে ২ হাজার ৫০০ টাকা দাবি করেন। কিন্তু তারা ২ হাজার টাকা দিতে সম্মত হন। এ নিয়ে ওই নারীর সঙ্গে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে নারী চিৎকার শুরু করলে তারা তিনজন মিলে গলা চেপে ধরে। একপর্যায়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। তারা ছাদে নিয়ে লাশ গুম করার পরিকল্পনা আঁটে। কিন্তু একপর্যায়ে সিঁড়িতে নিয়ে সেখানেই ওই নারীর লাশ ফেলে রাখে। সকালে ফারুকের চাচি কবুতরকে খাবার দেওয়ার জন্য ছাদে উঠতে গিয়ে লাশ দেখেন এবং পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ফারুকসহ অন্য দুই আসামি রাশেদ ও আলমগীরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর