মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

অস্তিত্ব সংকটে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য

রেড অ্যালার্টেও বন্ধ হয়নি বিষ প্রয়োগ, প্রাণী শিকার ও নাশকতা

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

অস্তিত্ব সংকটে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য

ভালো নেই ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রল হরিণ, জাতিসংঘ-ঘোষিত রামসার এলাকার জলভাগের মৎস্যসম্পদ। শুধু বন্যপ্রাণী ও মৎস্যসম্পদই নয়, নাশকতার আগুনে পুড়ছে সুন্দরবনও। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ‘স্মার্ট প্যাট্রলিং’ আর জেলে-বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে ঠেকানো যাচ্ছে না বাঘ, হরিণ হত্যা। বন্ধ হচ্ছে না খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার। ফলে অস্তিত্ব সংকটে অক্সিজেনের অফুরন্ত এ ভান্ডার।

সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি : অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। কমতে কমতে বাংলাদেশ অংশের আয়তন এখন দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার; যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির মোট ৫১ ভাগ। সংরক্ষিত এ বনের তিনটি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ঘোষণা করে। যেখানে রয়েছে সুন্দরি, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি। এ ছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েঝে। সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহৎ জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার; যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। ১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এ জলভাগকে রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এ ছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। এ জলভাগে ছোটবড় ৪৫০টি নদ-নদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার। এরই মধ্যে সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে ১ প্রজাতির বন্যমহিষ, ২ প্রজাতির হরিণ, ২ প্রজাতির গন্ডার, ১ প্রজাতির মিঠা পানির কুমির।

বিষ দিয়ে মাছ শিকার : করোনাকালে ২৬ মার্চ থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত গোটা সুন্দরবনে সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করে পর্যটক, জেলে-বনজীবীদের সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বন অধিদফতর। এ নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যেও একশ্রেণির জেলে বৈধ-অবৈধ পথে সুন্দরবনে ঢুকে অধিক লাভের আশায় খালে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ করে আসছে। গত ছয় মাসে সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে বিষ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ করার সময় ১০ ‘বিষসন্ত্রাসী’কে গ্রেফতারও করেছে বন বিভাগ। খালে বিষ দিয়ে মাছ আহরণের ফলে সুন্দরবনের মৎস্যভান্ডার মাছশূন্য হয়ে পড়ার পাশাপাশি খালে পানির বিষ বনের যেসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে সেসব বন এলাকার জীববৈচিত্র্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ছোটবড় সব প্রজাতির মাছ মারা যাওয়ার পাশাপাশি মারা পড়ছে রপ্তানিপণ্য বিশ্বখ্যাত শিলা কাঁকড়াসহ অন্যসব জলজপ্রাণী।

বাঘ, হরিণের চামড়া উদ্ধার : ২০ জানুয়ারি বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে একটি বাঘের চামড়াসহ এক পাচারকারীকে আটক করে র‌্যাব-৮। ২২ জানুয়ারি আবারও শরণখোলা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ দুই পাচারকারীকে আটক করে ডিবি পুলিশ। ২৫ জানুয়ারি খুলনার দাকোপ উপজেলার পানখালী খেয়াঘাট এলাকা থেকে ১১ কেজি হরিণে মাংসসহ দুজনকে আটক করে পুলিশ। ৩১ জানুয়ারি মোংলার দিগরাজ এলাকা থেকে ৪৭ কেজি হরিণের মাংসসহ তিনজনকে আটক করে কোস্টগার্ড, ২ ফেব্রুয়ারি রামপাল থেকে ৪৫ কেজি হরিণের মাংসসহ দুই পাচারকারীদের আটক করে ডিবি পুলিশ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মোংলার বৈদ্যমারী ফরেস্ট অফিসসংলগ্ন ইসহাকের চিলা এলাকা থেকে সুন্দরবনে শিকার করা হরিণের চারটি পা, আধা বস্তা ফাঁদ, দুটি ছুরি, একটি নৌকাসহ দুই শিকারিকে আটক করে বন বিভাগ।

২৭ বার নাশকতার আগুন : ৮ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর টহল ফাঁড়ির কাছে ২৭ নম্বর কম্পার্টমেন্টের বনে নাশকতার আগুনে পুড়ে গেছে ৫ শতক জমির বলাগাছ ও লতাগুল্ম। সুন্দরবন বিভাগের তথ্যমতে সুন্দরবনের বিলে মিঠা পানির মাছ আহরণ করতে গত ১৫ বছরে দস্যুদের লাগানো ২৭ বারের নাশকতার আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ৮০ একর বনভূমি। ২০১৭ সালের ২৬ মে ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ফরেস্ট ক্যাম্পের আওতাধীন আবদুল্লাহর ছিলায় অগ্নিকান্ড ঘটে। এতে প্রায় ৫ একর বনভূমির গাছপালা, লতাগুল্ম পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে চারটি রেঞ্জর ১৮টি রাজস্ব অফিস, টহল ফাঁড়িগুলোয় জনবলের সংখ্যা মাত্র ৮৮৯। এর মধ্যে পূর্ব বিভাগে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূন্য। এ অপ্রতুল জনবল দিয়ে সুন্দরবন রক্ষায় বন বিভাগকে তৎপরতা চালাতে হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর