বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বিনিয়োগ বাড়ে কাগজে কলমে

ব্যাংকে জমছে অলস টাকা, করোনায় ধস নেমেছে বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনে

মানিক মুনতাসির

বিনিয়োগ বাড়ে কাগজে কলমে

দেশে কাগজে কলমে বিনিয়োগ বাড়লেও বাস্তবে তা কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না। প্রতি তিন মাসে যতসংখ্যক বিনিয়োগ প্রস্তাব বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর কাছে নিবন্ধিত হয়, বছর শেষে তার মাত্র এক তৃতীয়াংশ প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে জাপান টোব্যাকোর ১৫০ কোটি ডলারের একটি বড় বিনিয়োগ এসেছিল বাংলাদেশে। এটি বাংলাদেশি প্রায় ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এরপর আর কোনো বড় বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি।

এমনকি চীন ও আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধ কেন্দ্র করে চীন থেকে ৮৬টি জাপানি কোম্পানি তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নেয় অন্যত্র। এ ক্ষেত্রে জাপানি ওইসব কোম্পানি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, মিয়ানমারে গেলেও বাংলাদেশে আসেনি একটিও। তবে অতিসম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীতে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ওই শিল্পনগরীর বিদেশি কোম্পানির শিল্প স্থাপন অংশের নির্মাণের সময়সীমা দুই বছর পেছানো হয়েছে। ফলে এখানে যেসব বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে তা চূড়ান্ত বিনিয়োগে রূপ নিতে অপেক্ষার প্রহর বাড়বে। এদিকে দেশি বিনিয়োগও বাড়ছে না কাক্সিক্ষত হারে। ফলে দেশের ব্যাংক খাতে জমছে অলস টাকার পাহাড়। নভেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোয় অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার কোটি; যা চলতি ফেব্রুয়ারি শেষে ২ লাখ কোটিতে পৌঁছতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর অর্থও শতভাগ বিতরণ করেনি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এটি বিনিয়োগে খরা না কাটার একটি কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিডাসূত্র জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিডায় বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব কমেছে প্রায় ৯৩ শতাংশ। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে ৭২ শতাংশ বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে। গত ৩ ডিসেম্বর বিডার তৎকালীন সিনিয়র ইভেন্ট কো-অর্ডিনেটর মনদীপ ঘড়াই স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। অবশ্য এরপর বিডার নতুন কোনো হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। তবে বিডাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ক্রমাগত কমছে। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতির কারণে নতুন করে কেউ বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। সবাই এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা

আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকগুলো তারল্যে ভাসছে এ কথা ঠিক নয়। অতিরিক্ত তারল্যের বড় একটা অংশ সরকারি বন্ড। চাহিদার চেয়ে বেশি বন্ড কেনা হয়েছে। ঝুঁকিবিহীন আয় হিসেবে সরকারি বন্ডে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করছে। তবে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ অনেক কম। ফলে অতিরিক্ত তারল্য বাড়ছে। আবার কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগও হচ্ছে না। বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে আগে থেকেই মন্দাভাব ছিল। করোনাভাইরাস মহামারী এ সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। নতুন করে বিনিয়োগে কেউ ঝুঁকি নিচ্ছেন না।’ পুঁজির নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তার জন্য তারা অনেকটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে তিনি মনে করেন। এদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সব ধরনের আইনি জটিলতা দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিডা, বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা), অর্থ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো একত্রে কাজ করছে। এসব সংস্থা, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধনে কাজ করছে বিডা। এ ছাড়া ১১টি সংস্থার ৪১ ধরনের পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এসব সংস্থার সার্বিক কার্যক্রমে গতি আনার নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। তবে বিদেশি বিনিয়োগ ধরতে গত ডিসেম্বরের মধ্যে দুটি আইনে সংশোধনী আনার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। এর একটি দেউলিয়াত্ব আইন, ১৯৯৭ এবং অন্যটি স্মল কোজেস কোর্টস অ্যাক্ট, ১৮৮৭। এ দুটি আইনের সংশোধন খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে পাস করা হতে পারে বলে জানা গেছে। অর্থ বিভাগ সূত্র জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথাও জানাবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে সংগতি রেখে করপোরেট করহার কমিয়ে আনা হতে পারে। বাংলাদেশে করপোরেট কর বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ প্রকাশের পর হোঁচট খেয়ে ফিরে যান বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, ‘সরকার অনেক দিন ধরেই কাজ করছে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, আমাদের গ্যাস-বিদ্যুতের অবস্থান অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন বাকি যে সূচকগুলো রয়েছে সেগুলোর ওপর আরও দ্রুত কাজ করা দরকার।’ তবে ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন থেকে সরে আসতে না পারলে কাক্সিক্ষত গতিতে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলে তিনি মনে করেন। সূত্র জানান, ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের চাপ সামলাতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে এনেছে। এক বছর আগেও যেখানে কোনো কোনো ব্যাংক ৮ শতাংশের বেশি সুদে তিন-ছয় মাস মেয়াদি আমানত সংগ্রহ করেছে এখন তা ৩-৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তার পরও অতিরিক্ত তারল্যের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যাংকারদের হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যাংকাররা। তাদের মতে পরিস্থিতি যা তাতে বিনিয়োগ বা ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে না পারলে অচিরেই ব্যাংক আমানতের সুদহার ১ থেকে ২ শতাংশে নেমে আসবে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সুদের হার কমিয়ে গ্রাহকদের দীর্ঘমেয়াদে আবাসন ঋণ দিচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আবেদন পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ঋণ অনুমোদন দিচ্ছে। আবার কেউ নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ আবেদন নিষ্পত্তি করছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে সুদের হার ৯ শতাংশে কার্যকর হওয়ার পর থেকে ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয় সুদ কমানোর। বিশেষ করে আবাসন ঋণ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আগের চেয়ে বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এর ফলে বেশির ভাগ ব্যাংকের দেওয়া ঋণের সুদহার সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর