বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁসে চিকিৎসক দম্পতি

৪৮ অ্যাকাউন্টে ২৩ কোটি টাকা লেনদেন

সাখাওয়াত কাওসার

মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁসে চিকিৎসক দম্পতি

মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে এক চিকিৎসক দম্পতির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে ডা. মুহাম্মদ ময়েজ উদ্দীন আহমেদ প্রধান ও তার স্ত্রী ডা. সোহেলী জামানের ৪৮টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২৩ কোটি টাকা লেনদেন এবং এফডিআরের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ডা. মুহাম্মদ ময়েজ উদ্দীন আহমেদ প্রধানের নামে গত বছর ১৯ জুলাই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে মিরপুর মডেল থানায় মামলা হলেও তাকে খুঁজে পাচ্ছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। গ্রেফতার অন্য আসামিদের জবানিতে উঠে এসেছে ময়েজ ও তার স্ত্রী ডা. সোহেলী জামানের নাম। সূত্র নিশ্চিত করেছে, মানি লন্ডারিংয়ে অভিযোগে এ দম্পতিসহ অন্তত ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৩ সাল থেকে রাজধানীর ফার্মগেটে ‘ফেইম কোচিং সেন্টার’ পরিচালনা করছিলেন ডা. ময়েজ। কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের আলাদাভাবে, এমনকি চুক্তিতে মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি করানোর চ্যালেঞ্জ ছুড়তেন তিনি। তবে এর আগে ‘শুভেচ্ছা’সহ কয়েকটি কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতেন ময়েজ। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তাদের আলাদাভাবে বিশেষ ক্লাস এবং মেডিকেল-ডেন্টালের ভর্তির প্রশ্নপত্র সরবরাহ করতেন তিনি। ২০০১-২০০২ সেশনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তির আগে শুভেচ্ছা কোচিং সেন্টারে কোচিং করতেন তার স্ত্রী ডা. সোহেলী। সেখানেই ময়েজ-সোহেলী প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যান। সোহেলীর সহপাঠীদের সন্দেহ, ডা. সোহেলী তার স্বামীর মাধ্যমে প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন। বিয়ের পর সোহেলী নড়াইলে ফেইমের একটি শাখা চালু করেন। ওই সেন্টার থেকেও অনেক ছাত্রছাত্রী মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এ চক্র দেশের মেধার সঙ্গে প্রতারণা করছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের এজেন্ট ছিল। তাদের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত যারা অবৈধভাবে প্রশ্ন নিয়ে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ময়েজকে গ্রেফতার করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে তিনি ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করছেন। আর তার স্ত্রী সোহেলী জামানের বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করতে চাইছি না।’ অনুসন্ধান সূত্র ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেডিকেল ও ডেন্টাল এবং মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের অন্যতম সদস্য ডা. ময়েজ। প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের অন্যতম প্রধান হোতা জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নুর সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন সময় গ্রেফতারের পর তাদের বিষয়ে তথ্য দেন বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান। সর্বশেষ গত বছর মিরপুর মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার পারভেজ, সানোয়ার, দিপুসহ চারজন এরই মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে ময়েজ ও তার স্ত্রী সোহেলীর নাম উল্লেখ করে তারা বলেছেন, তারা অনেক আগে থেকে পরস্পরের পরিচিত। ময়েজ মূলত চোখের ডাক্তার। জসিম ও তার পরিবারের লোকজন চোখের সমস্যা-সংক্রান্ত চিকিৎসার জন্য তার কাছে যেতেন। একপর্যায়ে তারা একসঙ্গে মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়ান। জবানবন্দিতে আসামিরা বলেন, ২০০০ সাল থেকে ময়েজ এ চক্রের সঙ্গে জড়িত। ময়েজের ফেইম নামে একটি মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার ছিল। সেই কোচিং সেন্টারের আড়ালে ফাঁস করা প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করাই ছিল তার মূল পেশা। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় একটি পাঁচতলা বাড়ি কিনেছেন ময়েজ। এ ছাড়া নিজ এবং স্ত্রীর নামে থাকা ব্যাক অ্যাকাউন্টে বিপুল অর্থ লেনদেন করেছেন। মুুহাম্মদ ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধানের বাবার নাম মোহাম্মদ আবদুল হক প্রধান। মা মনোয়ারা বেগম। রাজধানীর ৫২/৮ পূর্ব রাজাবাজারে তাদের বাসা। বিএফআইইউ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮ থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত ময়েজ উদ্দিনের নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৩৯টি হিসাব ও এফডিআর পাওয়া গেছে। ৩৯টি ব্যাংক হিসাবে তিনি মোট ১৯ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৫৮৯ টাকা বিভিন্ন সময় জমা করেছেন। তবে এরই মধ্যে তিনি ১৮ কোটি ১৮ লাখ ২৪ হাজার ৪৫০ টাকা উত্তোলন করে ফেলেছেন। এর বাইরে ময়েজের নামে রাজাবাজারে একটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে আইনগত ঝামেলা এড়ানোর কৌশল হিসেবে ২০১৪ সালের ১০ জুন ময়েজ ঢাকা ব্যাংক ধানমন্ডি শাখা থেকে ১০ কোটি ২২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৪৪ টাকা লোন নেন। ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৯ কোটি ২২ লাখ ৭ হাজার ৩৬২ টাকা পরিশোধ করে ফেলেছেন। ডা. সোহেলী জামান জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে কর্মরত। তার নামে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৯টি হিসাব ও এফডিআর পাওয়া গেছে। ৯টি ব্যাংকে হিসাবে তিনি ৩ কোটি ৩৫ লাখ ২৯ হাজার ৮৫১ টাকা জমা করেন। তবে এরই মধ্যে তিনি ৩ কোটি ৩৫ লাখ ২৩ হাজার ৪৩৮ টাকা উত্তোলন ও স্থানান্তর করে ফেলেছেন। নিজের আল-আরাফাহ ব্যাংক লিমিটেড, ধানমন্ডি শাখার হিসাব নম্বরে তিনি ২০০৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১ কোটি ২১ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৮ টাকা জমা করেন। এর মধ্যে ১ কোটি ২১ লাখ ৭৩ হাজার ৫৭১ টাকা উত্তোলন করেন। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ধানমন্ডি শাখার হিসাব নম্বরে ২০০৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ১ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৮ টাকা জমা করে ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ৮ লাখ ৯ হাজার ১৯০ টাকা টাকা উত্তোলন ও স্থানান্তর করে ফেলেছেন ডা. সোহেলী। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. সোহেলী জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সবগুলোই মিথ্যা।’ তার অ্যাকাউন্টে স্বামী ময়েজ শেয়ার লেনদেন করতেন বলে দাবি করেন তিনি। ২০২০ সালের ১৯ ও ২০ জুলাই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সিআইডি জসীম উদ্দীন ভূঁইয়া, পারভেজ খান, জাকির হোসেন ওরফে দিপু, মোহাইমিনুল ওরফে বাঁধন ও এস এম সানোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এ সময় জসিমের কাছ থেকে ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ২ কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক উদ্ধার করে পুলিশ। পারভেজের কাছ থেকে ৮৪ লাখ টাকার চেক উদ্ধার করে সিআইডি। পরে তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। এ ছাড়া বিএফআইইউ থেকে প্রাপ্ত অভিযুক্তদের মোট ১৩৩টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য (অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরম কেওয়াইসি, হিসাব বিবরণী ইত্যাদি) এরই মধ্যে সিআইডির কাছে এসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর