বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

১১ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওরা

ভুয়া এনআইডি, টিন ও ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার গ্রেফতার ৫, তিন দিনের রিমান্ডে

সাখাওয়াত কাওসার

ওরা ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), টিন ও ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নিত বিপুল অঙ্কের অর্থ। এরই মধ্যে ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২০ কোটি টাকার বিষয়টি জানতে পেরেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হবে। তবে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, ভয়ংকর এই চক্রের সদস্য রয়েছেন খোদ জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মচারী। অভিযোগের পর রাজধানীর খিলগাঁও ও রামপুরা এলাকা থেকে মো. আল আমিন ওরফে জামিল শরীফ, খ ম হাসান ইমাম ওরফে বিদ্যুৎ, মো. আবদুল্লাহ আল শহীদ, মো. রেজাউল ইসলাম ও মো. শাহ জামানকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগ। পরে গতকালই তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের নির্দেশে তিন দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। জানা গেছে, গ্রেফতারের পর অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। বেরিয়ে এসেছে থলের বেড়াল। তবে গতকাল সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, মঙ্গলবার রাতে খিলগাঁও ও রামপুরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে বিপ্লব ঘটনায় জড়িত থাকার কথা আদালতে স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। তার দেওয়া তথ্যমতে বাকিদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

জানা গেছে, নতুন ফ্ল্যাট কেনার বিপরীতে ৮৫ লাখ টাকা করে ঋণ নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে ৭ ও ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও ও পল্টন থানায় পৃথক দুটি মামলা করে ঢাকা ব্যাংক। মামলা দুটির তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হলে গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিম প্রতারকদের ধরতে অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানতে পারেন, এটি একটি পেশাদার প্রতারক চক্র। এই চক্রের সদস্যরা ভুয়া এনআইডি, ট্রেড লাইসেন্স ও টিন সার্টিফিকেট তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করতেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।’

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তারা বেশ কয়েক বছর ধরে ভুয়া এনআইডি তৈরি করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করতেন। ঢাকা ব্যাংকের দুটি ঘটনা ছাড়াও তারা ইতিমধ্যে যমুনা ব্যাংক থেকে তিনটি ঋণ, এনআরবিসি ব্যাংক থেকে একটি, ডাচ্্-বাংলা ব্যাংক থেকে একটি, সিটি ব্যাংক থেকে একটি, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে তিনটি, ওয়ান ব্যাংক থেকে দুটি, ফার্স্ট লিজিং থেকে পাঁচটি, পিপলস লিজিং থেকে তিনটি, প্রিমিয়ার লিজিং থেকে একটি ও ফনিক্স লিজিং থেকে একটি করে হোম লোন নিয়েছেন। এসব ঋণের পরিমাণ ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তারা ১১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

তদন্ত সূত্র বলছে, গ্রেফতার ছয় প্রতারকের মধ্যে মূল হোতা হলেন আল আমিন ওরফে জামিল শরীফ এবং খ ম হাসান ইমাম ওরফে বিদ্যুৎ। তারা দুজনই আগে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ব্যাংক থেকে ভুয়া পরিচয় দিয়ে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করে তারা ভুয়া এনআইডি তৈরি করার জন্য আবদুল্লাহ আল শহীদের কাছে যান। আবদুল্লাহ আল শহীদ একটি নামসর্বস্ব অনলাইনের প্রধান সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে ভুয়া এনআইডি তৈরি করে দেওয়ার কাজ করতেন। আল-আমিন ও বিদ্যুৎ কোনো ভুয়া এনআইডি তৈরির কাজ দিলে আবদুল্লাহ তা বিপ্লবের কাছে দিতেন। বিপ্লব আগারগাঁওয়ের যে ভবনে আগে জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভার অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানকার নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। বিপ্লব ভুয়া এনআইডি তৈরির জন্য সার্ভারের কয়েকজন কর্মচারীকে দিতেন। আর রেজাউল ইসলাম ও শাহ জামান এই চক্রটিকে জাল ট্রেড লাইসেন্স ও টিন সার্টিফিকেট তৈরিতে সহায়তা করতেন। মানিকনগর এলাকার এক ভুক্তভোগী আবু তাহের হোসেন খান। গতকাল সন্ধ্যায় তার ভাতিজা ইমন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মানিকনগর পুকুড়পাড় এলাকার একটি ফ্ল্যাটের ক্রেতা হিসেবে ওই প্রতারক চক্র আমাদের কাছে আসে। দরদাম ঠিক করে তারা আমার চাচার ভোটার আইডিসহ জমির দলিলের ফটোকপি নিয়ে যায়। কিছুদিন পর যমুনা ব্যাংকের ১ কোটি টাকার একটি উকিল নোটিস আসে আমাদের নামে। পরে আমরাও আদালতে একটি মামলা করি। একই সঙ্গে চাচা সশরীরে ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে দরখাস্ত দিয়ে আসেন।’ এক লাখ টাকায় ভুয়া এনআইডি : প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারক দলের হোতা আল-আমিন জানিয়েছেন, তিনি প্রতিটি ভুয়া এনআইডি তৈরির জন্য আবদুল্লাহকে ১ লাখ টাকা করে দিতেন। আবদুল্লাহ এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যে ভুয়া এনআইডি তৈরি করে দিতেন। এসব এনআইডির তথ্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সার্ভারে থাকত। এ জালিয়াত চক্রের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের চারজন কর্মচারীর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুজনকে জাল-জালিয়াতি করার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বিভাগ থেকে সম্প্রতি সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। এই চারজনকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আবদুল্লাহ জানান, তিনি এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ থেকে ৬০ ভুয়া এনআইডি তৈরি করে দিয়েছেন। আল-আমিন ও বিদ্যুৎ ছাড়া আরও যারা তার কাছ থেকে ভুয়া এনআইডি নিয়েছেন, তাদের নামও বলেছেন তিনি। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন। আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, তিনি ১ লাখ টাকা নিয়ে কিছু টাকা নিজের কাছে রেখে দিয়ে বাকি টাকা বিপ্লবকে দিতেন। বিপ্লব আবার কিছু টাকা নিজের কাছে রেখে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে এনআইডি অফিসের স্টাফদের দিতেন। অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষ গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছে, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তারা এই পর্যন্ত ৪৪ জনকে বহিষ্কার করেছে। এর আগেও ডিবি পুলিশের একটি দল প্রতারক চক্রকে গ্রেফতারের পর ভুয়া এনআইডি তৈরি করে দেন এনআইডি বিভাগের এমন কয়েকজন কর্মচারীকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করে।

প্রতারকদের কৌশলের বিষয়ে হাফিজ আক্তার বলেন, প্রথমে ব্যাংকে গিয়ে ফ্ল্যাট কেনার জন্য লোনের বিষয়ে ব্যাংকের লোকজনের সঙ্গে তারা পরামর্শ করেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা ভিজিটে যাওয়ার আগেই ফ্ল্যাট বিক্রির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হতো। একপর্যায়ে ওই ফ্ল্যাটের প্রকৃত মালিকের কাছ থেকে কৌশলে প্রতারক চক্র ফ্ল্যাটে তার এনআইডি কার্ড এবং ফ্ল্যাটের কাগজপত্রের ফটোকপি চাইত।

গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহীদুর রহমান রিপন জানান, গ্রেফতার আসামিদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছে পুরো চক্রটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা চলছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর