শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনের সাক্ষী খুনির মোবাইল ফোন

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনের সাক্ষী খুনির মোবাইল ফোন

রাত পোহালেই খুশির ঈদ। সন্ধ্যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে শাওয়ালের সরু বাঁকা চাঁদ দেখা গেছে। তাই আনন্দের জোয়ার বইছে সবখানে। কিন্তু ঈদের সেই আনন্দের পরিবর্তে শিক্ষক নাসির উদ্দিনের পরিবারে শুধুই কান্নার রোল। বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকের ছায়া। ঘুমের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। স্ত্রী মিতু, দুই সন্তান নুসরাত আর নাঈমকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও যেন উপস্থিত সবাই হারিয়ে ফেলেছিলেন। নাসির উদ্দিনের মৃত্যুর সংবাদে ছুটে আসে তার স্বজনরা। পরে সবার উপস্থিতিতে নাসির উদ্দিনের দাফন সম্পন্ন হয়। শোকেরও আয়ু আছে। সেই আয়ু এক সময় শেষ হয়। শোক ভুলে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকে। মিতু তার স্বামী এবং সন্তানরা তাদের বাবার মৃত্যুকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন শুরু করে। মিতু তার বাপের বাড়িতে চলে যায়। সেখানেই দুই সন্তান নিয়ে থাকেন। নাসিরের বাবা-মা, ভাই, বোনদের জীবন-যাপনও তেমনি স্বাভাবিক হতে থাকে। তাদের জীবনের সব কিছুই ঠিকঠাক চলছে, শুধু নেই নাসির উদ্দিন। একটা সময় এলাকার লোকজন ভুলে যেতে থাকে নাসিরকে। পরিবারের সদস্যদের হঠাৎ মনে পড়ে নাসিরকে। নাসিরের মৃত্যুর নয় মাস পর এলাকায় নানা গুঞ্জন। নাসিরের মৃত্যু নিয়ে কানাঘুষা চলছে। নাসিরের মৃত্যু স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। তাকে হত্যা করা হয়েছে। এমন কথা বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। তথ্য-প্রমাণ নাকি পুলিশের হাতে। এমন সব তথ্যে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে গোটা এলাকায়। এমন গুঞ্জনের মধ্যেই পুলিশ আকস্মিকভাবে গ্রেফতার করে নাসির উদ্দিনের স্ত্রী মিতুকে। শুধু তাকেই নয়, গ্রেফতার করা হয় স্থানীয় যুবক রাজু মিয়াকে। এই রাজু মিয়া হলো মিতুর প্রেমিক। তাদের গ্রেফতারের পর পুলিশ জেরা  শুরু করে। প্রথম দিকে তারা গড়িমসি করলেও তথ্য-প্রমাণ হাজিরের পর পুলিশকে বেগ পেতে হয়নি। দুজনই বলতে থাকে নাসির উদ্দিনের মৃত্যুর নেপথ্য কারণ। রাজুর সঙ্গে পরকীয়া ছিল মিতুর। লুকিয়ে তারা দেখা করতেন। শারীরিক সম্পর্ক গড়তেন সময়-সুযোগ পেলেই। কিছুদিন পর তাদের এভাবে লুকিয়ে ছাপিয়ে দেখা করতে ভালো লাগত না। তারা আরও বেশি সময় ধরে এক সঙ্গে থাকতে চাইতেন। কিন্তু বাধা ছিল মিতুর স্বামী নাসির উদ্দিন। তিনি তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। এতে করে তাদের দেখা-সাক্ষাৎও কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই বাধা মিতু রাজু কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না। সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে তারা দুজন মিলে এই বাধা উপড়ে ফেলে সিদ্ধান্ত নেন। তারা ভেবেছিলেন এই বাধা ভেঙে ফেলতে পারলেই তারা সুখে শান্তিতে পরবর্তী জীবন এক সঙ্গে কাটাতে পারবেন। সে মতে ২০২০ সালের ২৩ মে ঈদের আগের রাতেই খুন করবে বলে পরিকল্পনা নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা নাসির উদ্দিনকে খাওয়ার সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়। ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত খাবার খাইয়ে দিলে নাসির বেঘোর ঘুমায়। ওই সুযোগেই তারা দুজন কম্বল চেপে শ্বাসরোধ করে নাসিরকে হত্যা করে। পরে তারা সবাইকে জানায় ঘুমের মধ্যেই হার্টঅ্যাটাক করেছেন নাসির উদ্দিন। এসব পুরো ঘটনাই তারা দুজনে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। 

যেভাবে রহস্য উদঘাটন : মিতুর প্রেমিক রাজু তার মোবাইল ফোনটি বরগুনার ঢলুয়ার বাজারের একটি দোকানে চার্জে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে রাজুর মোবাইলটি কে বা কারা চুরি করে নিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া সেই মোবাইলে নাসির হত্যার পরিকল্পনা এবং পরবর্তী বিষয়ের রাজু ও মিতুর কথোপকথনের রেকর্ড জমা ছিল। যারা এই মোবাইল ফোনটি চুরি করেছিলেন, তারা মোবাইলের এসব রেকর্ড শুনে। রেকর্ড শুনেই তারা বুঝে নেয় এটি নাসির খুনের ঘটনার কথাবার্তা। তারা নাসির উদ্দিনের বাবা এবং ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বরগুনা সদর থানায় অভিযোগ করেন নাসিরের বড় ভাই মো. জলিল হাওলাদার।

অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নামে পুলিশ। তদন্তে ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে নাসিরের স্ত্রী ফাতেমা মিতু (২৪) ও তার প্রেমিক রাজু মিয়াকে (২০) গ্রেফতার করে পুলিশ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর