শনিবার, ৬ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
চাকচিক্যের ঢাকায় অমানবিক জীবন

বর্জ্যে চাপা শিশুর দুরন্ত শৈশব

শামীম আহমেদ

বর্জ্যে চাপা শিশুর দুরন্ত শৈশব

রাজধানীর মাতুয়াইলে বর্জ্যরে ভাগাড় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১১টা। রোদের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল দুর্গন্ধ। হাজার হাজার টন বর্জ্য সমান করার চেষ্টা করছে হাইড্রোলিক বুলডোজার। যেখানেই বর্জ্য নাড়াচাড়া হচ্ছে সেখানেই ছুটে যাচ্ছে সানু, বক্কর, সালমা, হোসেনরা। প্রায় সবারই বয়স ১০ বছরের নিচে। কচি হাতে আবর্জনা হাতড়ে বের করছে প্লাস্টিকের বোতল, কাচের শিশি, পুরনো লোহার টুকরো, গরু-মহিষের হাড়সহ নানা কিছু। এরপর সেগুলো ঢোকাচ্ছে পিঠে ঝোলানো ব্যাগে। দুর্গন্ধে ভ্রুক্ষেপ নেই মোটেও। গত রবিবার রাজধানীর আমিনবাজারে উত্তর

সিটির স্যানিটারি ল্যান্ডফিল্ডে (আবর্জনা ফেলার স্থায়ী জায়গা) গিয়ে দেখা যায় এমন চিত্র। রাজধানী ঢাকাকে একটি আধুনিক, পরিচ্ছন্ন ও মানবিক শহর হিসেবে গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বর্তমান দুই সিটি মেয়র। সরকার সব শিশুর শিক্ষা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে নিয়েছে নানা পদক্ষেপ। স্কুলগামী শিশুদের দেওয়া হচ্ছে উপবৃত্তিসহ নানা সুবিধা। তার পরও খোদ রাজধানীতে অসংখ্য শিশুর বইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের আগেই পরিচয় হচ্ছে বর্জ্যরে সঙ্গে। অর্থ আয়ের জন্য দিনভর  ঘুরে বেড়াচ্ছে বর্জ্যরে ভাগাড়ে।

গত রবিবার সরেজমিন পরিদর্শনকালে আমিনবাজার ল্যান্ডফিল্ডজুড়ে আবর্জনা থেকে ‘সম্পদ’ কুড়াতে ব্যস্ত ছিল শ-খানেক মানুষ। এর মধ্যে ৩০ থেকে ৪০টি শিশু। অন্যরা কিশোর-কিশোরী ও প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ। সানু-সালমাদের সঙ্গে কথা বলতে অপেক্ষা করতে হয় অনেক সময়। আবর্জনা কুড়ানোর প্রতিযোগিতার মধ্যে আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের কম। টাকা দেওয়ার শর্তে রাজি হয় কথা বলতে। তার পরও কথা বলার ফাঁকেই বারবার দৌড়ে যাচ্ছিল হাইড্রোলিক বুলডোজারের দিকে; যদি আবর্জনা থেকে ভালো কিছু বেরিয়ে আসে! খালি পায়ে দিনের পর দিন বর্জ্যরে মধ্যে হাঁটাহাঁটিতে প্রত্যেকেরই পায়ের আগুলের খাঁজগুলোতে ঘা হয়ে গেছে। হাতেও চর্মরোগ অনেকের। সানু জানায়, ভোর ৬টার মধ্যেই তারা হাজির হয় ল্যান্ডফিল্ডে। কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি করে রোজ ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়। কোনোদিন আরও বেশি। যে আগে আসতে পারে, সে ভালো মাল পায়। সানুর মা অন্যের বাসায় কাজ করে। আলাপে জানা যায়, তাদের অধিকাংশের বাসা আশপাশেই বিভিন্ন বস্তিতে। কেউ থাকে সড়কে। কারও বাবা নেই। কারও বাবা-মা কেউই নেই। কারও বাবা-মা থাকার পরও সংসারে রোজগার বাড়াতে শিশু সন্তানকে পাঠিয়ে দিয়েছে বর্জ্যরে ভাগাড়ে। আবার কিছু শিশু বর্জ্য কুড়াতে এসেছে সমবয়সীদের আমন্ত্রণে। রাজধানীর মাতুয়াইলের স্যানিটারি ল্যান্ডফিল্ডেও দেখা যায় একই চিত্র। এ ছাড়া রাজধানীর প্রায় সব ডাস্টবিন ও এসটিএস (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন)-এ বর্জ্য থেকে বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী কুড়াতে দেখা গেছে শিশুদের। বিভিন্ন রেলস্টেশন ও বাসস্ট্যান্ডেও কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বোতল কুড়াতে দেখা গেছে শিশুদের। বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহেও দেখা গেছে কোমলমতি শিশুদের। শিশুর অধিকার, শিশুশ্রম, স্কুলে যাওয়া বা শৈশব-কৈশোর নিয়ে চিন্তা তাদের নেই। শুধু জানে, আয় করলেই জুটবে খাবার। ময়লার স্তূপে চাপা পড়ছে এসব শিশুর শৈশব। টোকাই নামের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে নিজের নামটিও।

বেসরকারি সংগঠন গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটি বর্জ্যজীবী শিশু ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাজ করছে ২০০৮ সাল থেকে। এ সংগঠনের হিসাবে, ২০১৩ সালে মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল্ডে কাজ করা তালিকাভুক্ত শিশু ছিল ৩৭৬ জন। বাবা-মায়ের হাত ধরেই তারা এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আসে। বর্তমানে দিনের বিভিন্ন সময়ে এখানে প্রায় ৪০০ শিশু বর্জ্য সংগ্রহ করছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাকসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ ল্যান্ডফিল্ডকে ঘিলে আড়াই হাজার পরিবারের জীবিকা চলে। কেউ বর্জ্য সংগ্রহ করে, কেউ সেগুলো আলাদা করে, কেউ আবার ধোয়ার কাজ করে। এর মধ্যে আট শতাধিক শিশু শুধু বর্জ্য থেকে বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী কুড়ায়। কয়েক দিন পর পর অসুস্থ হওয়ায় সব শিশু নিয়মিত আসতে পারে না। তবে গড়ে দৈনিক ৪০০ শিশু এখানে বর্জ্য কুড়ায়। আমরা ল্যান্ডফিল্ডের পাশে স্কুল করে এই শিশুদের একটা অংশকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াচ্ছি। খাবার দিচ্ছি। প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্যত্র কাজের ব্যবস্থা করছি। বর্তমানে ২১৬টি শিশু স্কুলে পড়ছে। তবে এভাবে সমাধান হবে না। সরকারকে এসব শিশুর দায়িত্ব নিতে হবে। শিশুশ্রমের কথা বলে এদের কাজ বন্ধ করে দিলেই সমাধান হবে না। তাদের খাবার ও অন্যান্য দায়িত্বও নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর