সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

থেমে গেছে অভিযান নজরদারিতেও ভাটা

স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি

সাখাওয়াত কাওসার

হঠাৎ করেই যেন রহস্যজনক কারণে থেমে গেছে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের নানা অভিযোগ এলেও সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না আইন প্রয়োগকারী কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মতো সংস্থা। যদিও একসময় দুদকের হটলাইন ‘১০৬’-এ কল দেওয়ামাত্রই হাজির হতো বিশেষায়িত টিম। কিছুটা হলেও স্বস্তিতে ছিলেন ভুক্তভোগীরা। তবে চলমান পরিস্থিতিতে আবারও স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতির অতলে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে এক বছর আগে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে স্বাস্থ্য খাতের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদবিবরণী চাওয়া হলেও গতকাল পর্যন্ত দুদকের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অগ্রগতির বিষয় জানানো হয়নি। যদিও দুদক বলছে, মাঝখানে করোনা মহামারীর কারণে একটু স্থবির থাকলেও সম্প্রতি আবারও কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে এ খাতের সন্দেহভাজনদের।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য খাতে দুদকের নজরদারিতে হঠাৎ করেই ভাটা পড়েছে। চোখে পড়ছে না দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের তোড়জোড়। অনিয়ম-দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা স্বাস্থ্যের গুটিকয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে দুদক অনুসন্ধান এবং মামলা দায়ের করলেও রাঘব-বোয়ালরা রয়ে গেছে এখনো অধরা। যাদের নামে মামলা করা হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই উচ্চ আদালতের জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ফুরফুরে মেজাজে। দুই বছর আগেও ২০১৯ সাল পর্যন্ত নানা অনিয়ম দুর্নীতির জন্য দুদকের হটলাইন ১০৬-এ কল করলে হাজির হতো বিশেষায়িত টিম। সেই টিম দেশের বিভিন্ন এলাকার হাসপাতালে একযোগে অভিযান চালিয়ে অপরাধী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ্ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে অভিযান চলমান আছে। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান র‌্যাবের ম্যান্ডেটের বাইরে। দুদক যদি র‌্যাবের সহযোগিতা চায় তাহলে আমরা সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য।’ ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি দেশের আট জেলার ১০টি            সরকারি হাসপাতালে একযোগে অভিযান চালানোর পর দুদকের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, হাসপাতালগুলোতে ৪০ শতাংশ চিকিৎসককেই অনুপস্থিত পাওয়া যায়। তবে উপজেলা পর্যায়ে এ হার সবেচেয়ে বেশি দেখা গেছে। প্রায় ৬২ শতাংশ চিকিৎসকই কর্মস্থলে ছিলেন না। হাসপাতালগুলো ছিল- ঢাকার ফুলবাড়িয়ার কর্মচারী কল্যাণ হাসপাতাল, নাজিরাবাজারের মা ও শিশু সদন, রংপুরের পীরগাছা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, দিনাজপুর সদর হাসপাতাল, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পাবনা সদর হাসপাতাল ও আটঘরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এর বাইরেও বিভিন্ন সময় অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে নানা অনিয়মের প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। পরবর্তী সময়ে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণাদিসহ উপস্থাপন করে অবহিত করা হয়েছে। দুদকের ভাষ্যমতে, ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি সংস্থাটি স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি ক্রয়, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি কিংবা ওষুধ সরবরাহের ১১ পর্যায়ে দুর্নীতি চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে ২৫টির মতো সুপারিশ জমা দিয়েছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে দুদকের এই প্রতিবেদন তুলে দিয়েছিলেন কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান। এরপর সরকারি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে কেনাকাটায় দুর্নীতি, অপ্রয়োজনে যন্ত্রপাতি কেনার নামে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, নিম্নমানের চিকিৎসা-সামগ্রী কিনে তা বেশি মূল্য দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে দুদক। সংস্থাটির উপপরিচালক সামছুল আলমের নেতৃত্বাধীন টিম ২০১৭-২০১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমে রীতিমতো থমকে যায়। শুধু দুই অর্থ বছরেই বিপুল পরিমাণ অর্থ তছরুপের তথ্য পায় দুদক। ২০১৯ সাল থেকে অনুসন্ধান শুরুর পর স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির অভিযোগে এ পর্যন্ত ২৫টির মতো মামলা হয়েছে। আরও প্রায় ২০ থেকে ২৫টি মামলা দায়ের হওয়ার প্রক্রিয়াধীন। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান কমিশন প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কমিশন ২০১৭ সালেই স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করেছিল। ২০১৯ সালের প্রারম্ভে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির ১১টি উৎস ও তা নিয়ন্ত্রণে ২৫ দফা সুনির্দিষ্ট সুপারিশ-সংবলিত কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত একটি প্রতিবেদন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সচিবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেই প্রতিবেদন পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা গেলে হয়তো স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরা সম্ভব হতো।

তিনি বলেন, ঢাকা, সাতক্ষীরা, রংপুর, চট্টগ্রাম, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা-সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগেও কমিশন থেকে ২৫টির মতো মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় সম্পৃক্ত ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে সুপারিশ করা হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান এখনো শেষ হয়নি। এ ছাড়া বর্তমানে সাত থেকে আটটি মামলা প্রক্রিয়াধীন এবং আরও ১০ অভিযোগ অনুসন্ধানে আছে।

জানা গেছে, স্বাস্থ্যের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজাল-রুবিনা দম্পতি গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর পর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে স্বাস্থ্যের অনিয়ম-দুর্নীতির থলের বেড়াল। অনুসন্ধান শেষে আবজাল-রুবিনা দম্পতির সাড়ে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ থাকার তথ্য পেয়ে মামলা করে দুদক। গত বছর পর্যন্ত দুদক ২৪টির বেশি মামলা করেছে। এসব মামলায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারসহ অনেককেই আসামি করা হয়। কিন্তু আবজাল দম্পতি ছাড়া কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি দুদক। দুর্নীতির মামলার আসামিরাও বহাল তবিয়তে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে মাস্কসহ চিকিৎসা সুরক্ষাসামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ, ডা. সাবরিনাসহ অনেকেই গ্রেফতার হন। পরে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। ওই সব ঘটনায়ও মামলা হয়। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ গড়া, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হন স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেক। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর ড্রাইভার মালেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, সাবেক মন্ত্রীর পিএসসহ অনেক প্রভাবশালীর ওপর নজর রাখে সংস্থাটি। তাদের অবৈধ সম্পদের বিষয়েও অনুসন্ধান চলমান। দুদকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৭ কোটি ৪৮ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সামগ্রী কেনাকাটার নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের নামে মামলা করা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ জুন আবজাল দম্পতির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি মামলা করে দুদক। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার নামে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসেন, ঠিকাদার আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করে সরকারি এ সংস্থাটি। সাতক্ষীরা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) যন্ত্রপাতি কেনার নামে ১১ কোটি ৭৪ লাখ ৬৩ হাজার টাকার বেশি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় দুদক। এ ছাড়া সাতক্ষীরা ম্যাটসের যন্ত্রপাতি কেনার নামে ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৫৭ হাজার টাকার বেশি আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। কুড়িগ্রাম হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কেনার নামেও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় দুদক। গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কেনার নামে ২৫ কোটি ৬ লাখ ৬৩ হাজার টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায় সংস্থাটি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কেনার নামে ৬৫ কোটি ৮২ লাখ ২১ হাজার টাকার বেশি আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি কেনার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় দুদক। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০ কোটি টাকার নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। আরেক অর্থবছরে শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩ কোটি ২৫ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি কেনার নামে আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পায় দুদক। ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে ২৫ কোটি ৭১ লাখ ৪৭ হাজার টাকার বেশি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মেলে। নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা হাসপাতালে ১৯ কোটি ১৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকার বেশি নিম্নমানের সামগ্রী কেনার প্রমাণ পায় দুদক। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২১ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার টাকার বেশি অর্থ নিম্নমানের চিকিৎসা-সামগ্রী সরবরাহ করে আত্মসাতের প্রমাণ পায় দুর্নীতি প্রতিরোধে নিয়োজিত এ সংস্থাটি। দুদক সূত্র জানায়, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়া, সিলেট, গাইবান্ধার সিভিল সার্জন অফিসের মালামাল কেনার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে দুদকে। এ ছাড়া টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রাপাতি কেনার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পেয়েছে দুদক। দুদকের পরিচালক (মিডিয়া) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেখুন, দুদকের অনুসন্ধান বন্ধ আছে এটা ঠিক নয়। তবে অনেক অভিযানের বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানানো হয়নি।’ শিগগিরই আবার অভিযান দেখতে পাবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর