বুধবার, ১০ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ওরা কিশোর খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

ওরা কিশোর খুনি

টিপু সুলতান, বাদশা মিয়া ও পিয়াস আহমেদ। বয়স ১৩ থেকে ১৫। ২২ বছরের তরুণ আরিফকে তারা রেললাইনের ওপর ফেলে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। আরিফের বন্ধু শামীম বাধা দিতে গেলে তার ওপরও হামলে পড়ে। শামীমের শরীরে ২৮ বার ছোরার আঘাত বসায়। থানায় নিয়ে পুলিশ যখন তাদের জেরা করছিল তিন কিশোর খুনি ছিল ভাবলেশহীন। এ তিন কিশোর খুনি সম্পর্কে এক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘ওদের যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি! জেরার সময় কপালে দু-এক ফোঁটা ঘাম ছাড়া কোনো ফারাক নজরে আসেনি। দাগি খুনিদেরও এমন হয় না।’ চট্টগ্রামের ঘটনা এটি। চকবাজারে নির্মাণকাজ শেষে আরিফ ও শামীম রেললাইন ধরে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। পুলিশ জানিয়েছে, রেলস্টেশনকে কেন্দ্র করে কিশোর অপরাধীদের সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র সক্রিয়। ওরা রেললাইনের আশপাশে ওত পেতে থাকে। মাদক সেবন করে। কাউকে একা পেলে কিংবা নিরীহ লোকজন দেখলে ছিনতাইয়ের জন্য হামলে পড়ে। এটি সারা দেশের চিত্র। কিশোর বয়সীরা ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পেশাদার খুনি হিসেবেও আবির্ভূত হচ্ছে কেউ কেউ। কিশোর অপরাধীদের মধ্যে স্কুলছাত্র রয়েছে। রয়েছে পথশিশু। তবে বস্তি এলাকায় অরক্ষিতভাবে বেড়ে ওঠা কিশোররাই বেশি অপরাধ তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীর গুলিস্তানের ফুটপাথে, কমলাপুর রেলস্টেশনে, সব বাস টার্মিনাল ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালসহ অলিগলি এবং বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে অর্ধলক্ষাধিক শিশু-কিশোর বেড়ে উঠছে। এর অধিকাংশই সংসারছাড়া, ছিন্নমূল। অনেকের জন্ম ফুটপাথেই। অভিভাবকবিহীন এ পথশিশুরা অযত্ন-অবহেলায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

রাজধানীর শীর্ষসন্ত্রাসী ও পেশাদার কিলারের অনেকের উত্থান ফুটপাথ থেকেই। অন্যদিকে শহরের অভিজাত এলাকার সন্তানরাও জড়িয়ে যাচ্ছে অপরাধে। তাদের মধ্যে মাদক গ্রহণ ও মাদক ব্যবসার প্রবণতাই বেশি। সম্প্রতি ইয়াবা চক্রের সঙ্গে জড়িত আটকের অনেকেই বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় রাস্তায় বেড়ে ওঠা কিশোর অপরাধীরা অর্থের জন্য অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে। অভিজাত কিশোর অপরাধীরা বন্ধুদের সঙ্গে নিছক মজা করে অপরাধের পথে পা বাড়ায়। পরে নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং, দ্বন্দ্ব আর স্বার্থের কারণে বড় ধরনের অপরাধ করে বসে। অপরাধ বিশ্লেষক ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে পরিবেশের প্রতিকূলতা ও অভিভাবকের উদাসীনতায় অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা দুর্ধর্ষ অপরাধী হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ই কিশোর অপরাধের প্রধান কারণ। সামাজিক অস্থিরতা, পরিবারের বন্ধনহীনতায় এ অবস্থার অবনতি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক নেতাদের ও পরিবারকেই এ অবস্থা রোধে ভূমিকা রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যে বয়সে এসব কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে সে বয়সটা কৌতূহলের। এ সময় তাদের হাতে অস্ত্র ও টাকা ধরিয়ে দিয়ে প্রভাবিত করা যায়। তাদের “সাহস আছে” বা “তোমাকে দিয়ে হবে”, এসব কথা বলে অপরাধ করতে উৎসাহ দেয় গডফাদাররা। অপরাধ করলে পরিণামে কী হবে সে হিতাহিত জ্ঞান তাদের থাকে না। বস্তি এলাকা বা পথশিশুদের মধ্যে কিশোর অপরাধীর হার বেশি। এদের আমরা “কন্ট্রাক্ট ডিজঅর্ডার” বা “জুবেনাইল ডেলিগ্রেন্ট” বলি।’

তিনি আরও বলেন, ‘অধিকাংশ কিশোর অপরাধী নিম্নবিত্ত, বস্তির বাসিন্দা। অভিভাবকহীন এসব শিশু বিভিন্নভাবে নিগৃহীত ও অপরাধের শিকার। তাই একসময় তারাই হয়ে ওঠে অপরাধী। তবে বিত্তশালীদের মধ্যেও অপরাধী হয়ে ওঠার প্রবণতা আছে।’ পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অপরাধ করার পর ধরা পড়া সন্ত্রাসীর একটি বড় অংশ কম বয়সী। তাদের সম্পর্কে আগে থেকে তথ্য পাওয়া যায় না। বড় সন্ত্রাসীরা পলাতক ও গা ঢাকা দিয়ে চলায় তাদের জায়গায় উঠে আসছে এসব নতুন সন্ত্রাসী। এদের অপরাধের কৌশলও ভিন্ন। তবে সব টিমের তৎপরতায় এখন তারা ধরা পড়তে শুরু করেছে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর