বৃহস্পতিবার, ১১ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনের রহস্য সিগারেটের প্যাকেটে

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনের রহস্য সিগারেটের প্যাকেটে

নীলফামারীর কামারপুকুর ইউনিয়নের মৎস্য খামারের পেছনের বাঁশঝাড় থেকে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশটি একটি গাছের সঙ্গে গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঝুলন্ত ছিল। পুলিশ নারীর লাশ ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে এনে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তুতি নেয়। পুলিশ এ সময় নারীর কোমরে গুঁজে রাখা একটি সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পায়। তাতে লেখা ছিল ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ পুলিশ প্রথমে এটিকে আত্মহত্যা বলে ভাবলেও সুরতহাল করতে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায়, শরীরে বেশ কিছু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পুলিশের সন্দেহ হয়, এটি আত্মহত্যা নয়, খুনের ঘটনা। হত্যার পর ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হতে পারে। অধূমপায়ী একজন নারীর কোমরে অস্বাভাবিক মৃত্যুর এমন একটা নোট পেয়ে তাকে মামলার গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স হিসেবে গ্রহণ করেন মামলা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরপর এই সুইসাইড নোট ধরেই এগিয়ে যায় খুনের তদন্ত। কামারপুকুর ইউনিয়নের কিসামত কামারপুকুর গ্রামের             হাবিবুর রহমান হাবিলও ছুটে যান। তিনি লাশ শনাক্ত করে বলেন, মৃত নারী তার বোন আকলিমা। তার অভিযোগ, আকলিমার স্বামী তাকে হত্যা করেছে। পুলিশ জানতে পারে, প্রায় আট বছর আগে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার হাবরা ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের আনিছুর রহমানের ছেলে শরিফুল ইসলামের (২৮) সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আকলিমার। পারিবারিক কলহের জেরে স্বামী শরিফুল ইসলাম সন্তানদের রেখে ঘটনার ১০ থেকে ১২ দিন আগে আকলিমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এ অবস্থায় আকলিমা বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু বাবার বাড়িতেও পরিবারের লোকজন তাকে মেনে না নিয়ে গালমন্দ করেন। এই দুঃখে আকলিমা ২০২০ সালের ২২ আগস্ট বাবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এর পরই লাশ পাওয়া যায় আকলিমার।

আকলিমার ভাই বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয় আকলিমার স্বামী শরিফুলকে। পুলিশ শরিফুলকে গ্রেফতার করে। কিন্তু তার কাছ থেকে হত্যা সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য পায় না।

তদন্ত কর্মকর্তা সেই সুইসাইড নোট নিয়ে তদন্ত শুরু করে। সিগারেটের প্যাকেটটি ছিল ডার্বি ব্র্যান্ডের। তদন্ত কর্মকর্তা ওই গ্রামের ডার্বি ধূমপায়ীদের শনাক্ত করতে কাজ শুরু করেন। এমন ৫০ থেকে ৬০ জনকে পাওয়া যায়, যারা ডার্বি সিগারেট পান করে থাকেন। এরপর কৌশলে ডার্বি ধূমপায়ীদের হাতের লেখা পরীক্ষা করতে শুরু করেন। একে একে প্রত্যেককেই সাদা কাগজে নিজেদের নাম বা গ্রামের নাম লিখতে বলেন তদন্ত কর্মকর্তা। সিংহভাগ ডার্বি ধূমপায়ীর লেখা পরীক্ষা হয়ে গেলেও হাতের লেখা মেলে না। এতে হতাশা পেয়ে বসে তদন্ত কর্মকর্তার মধ্যে। বাকি আরও ৭-৮ জন রয়েছেন। যদি না মেলে হাতের লেখা, তবে অন্য কোনো পথে এগোতে হবে তদন্ত কর্মকর্তাকে। এমন চিন্তা নিয়ে শেষ কয়েকজনের হাতের লেখা পরীক্ষা করতে থাকেন তদন্ত কর্মকর্তা। আনারুল নামে একজনের হাতের লেখার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। আশার আলো দেখতে পান তদন্ত কর্মকর্তা। আনারুলকে থানার হাজতে নিয়ে বসানো হয়। এরপর শুরু হয় জেরা। পুলিশকে হতবাক করে দিয়ে আনারুল খুনের কথা স্বীকার করে ফেলেন। 

জেরার মুখে আনারুল জানান, ‘কামারপুকুর মৎস্য খামার এলাকায় ঘোরাফেরা করছিল আকলিমা। আমি আমার বন্ধু শুভ এবং হৃদয় সেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আকলিমাকে দেখে আমরা তাকে ডাক দিই। সে কাছাকাছি এলে আমরা খাবার ও টাকা দিতে চাই। কিন্তু সে নিতে রাজি হয়নি। এক পর্যায়ে আমরা তাকে ধরে নিয়ে যাই পাশের বাঁশঝাড়ে। সেখানে তিনজনে মিলে তাকে ধর্ষণ করি। কিন্তু আকলিমা এ ঘটনা সবাইকে বলে  দেবে বলে হুমকি দেয়। এতে আমরা ক্ষুব্ধ হই। তাকে আমরা গলা চেপে ধরলে সে মারা যায়। পরে তার গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলয়ে রাখি। আর সিগারেটের প্যাকেটের রাংতা কাগজে লিখি, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। সেই কাগজটা আকলিমার কোমরে গুঁজে দিই। যেন সবাই বুঝতে পারে, সে আত্মহত্যা করেছে।’ আনারুলের দেওয়া তথ্যে পরে পুলিশ শুভকেও গ্রেফতার করে।

সর্বশেষ খবর