শুক্রবার, ১২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

অনলাইনে বেচাকেনায় বাড়ছে প্রতারণা ঝুঁকিতে সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাত

শামীম আহমেদ

অনলাইনে বেচাকেনায় বাড়ছে প্রতারণা ঝুঁকিতে সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাত

অনলাইনে পণ্য বেঁচাকেনায় বাড়ছে প্রতারণার ঘটনা। আসল পণ্যের ছবি দেখিয়ে নকল পণ্য গছিয়ে দেওয়া, বিকাশে অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য না পাঠানোসহ প্রতারণার নানা অভিযোগ উঠছে অনেক নামসর্বস্ব ই-কমার্স ‘প্রতিষ্ঠানের’ বিরুদ্ধে। এ নিয়ে কেউ কেউ আইনের দ্বারস্থ হলেও অধিকাংশই অহেতুক ঝামেলা এড়াতে বিষয়টা চেপে যাচ্ছেন। আবার আইনের দ্বারস্থ হলেও সহসাই মিলছে না সুরাহা। প্রতারণার কারণে ই-কমার্সের প্রতি ক্রমেই আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। ঝুঁকিতে পড়ছে ৮ হাজার কোটি টাকা বাজারমূল্যের সম্ভাবনাময়ী খাতটি।

করোনায় লকডাউনের সময় ঘরে ঘরে পণ্য পৌঁছে দিয়ে সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ই-কমার্স। প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত দ্রুত গতির ইন্টারনেট পৌঁছে যাওয়ায় দ্রুত বাড়ছে ই-কমার্সের পরিধি। ইতিমধ্যে এতে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। প্রতিদিন এই খাতে বাড়ছে উদ্যোক্তা ও কর্মীর সংখ্যা। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে হচ্ছেন স্বাবলম্বী। অথচ, কিছু প্রতারক ও অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে ঝুঁকিতে পড়ছেন এই খাতে বিনিয়োগ করা অনেক নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। সবচেয়ে বেশি প্রতারণার ঘটনা ঘটছে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৈরি করা ব্যবসায়ী পেজগুলোতে। অনেকে ফেসবুকে পেজ খুলে দামি পণ্যের ছবি দিয়ে নামমাত্র মূল্যে বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। সঙ্গে বলা হচ্ছে ‘স্টক থাকা পর্যন্ত অফারটি চলবে’। পণ্যটি পেতে মোট মূল্যের একটি অংশ বা কুরিয়ার চার্জ অগ্রিম বিকাশে পাঠানোর অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু, টাকা পাঠানোর পর আর দেওয়া হচ্ছে না পণ্য। এমনকি ক্রেতা যাতে ওই ফেসবুক পেজে গিয়ে অভিযোগ দিতে না পারে সেজন্য তাকে ব্লক করে দেওয়া  হচ্ছে। কেসস্টাডি-১ : গত ২ ফেব্রুয়ারি ‘ডেনিম জ্যাকেটস শপ’ নামের ফেসবুক পেজ থেকে একটি জ্যাকেট কিনতে তাদের পারসোনাল বিকাশ নম্বরে (০১৭২৭-৭৫২০৯৩) ৯০০ টাকা পাঠান বেসরকারি চাকরিজীবী শাকীর এহসানুল্লাহ। ওই দিন রাতের মধ্যে পণ্যটি পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। তবে মাস পার হলেও সেই জ্যাকেট আর হাতে পাননি শাকীর। পেজটিতে দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তিনি। গতকাল শাকীর বলেন, অন্য নম্বর থেকে ফোন করলে রিসিভ করে, কিন্তু জ্যাকেটের কথা বললে ফোন কেটে দেয়। এ নিয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানায় সাধারণ ডায়েরি (নম্বর-৮৯৭) করেছি। এর আগে প্রতারক প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক ইউআরএল, তাদের বিকাশ ও মোবাইল নম্বর, বিকাশে টাকা পাঠানোর ট্রানজেকশন নম্বর, তাদের সঙ্গে আলাপের স্ক্রিনশটসহ বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ যুক্ত করে অভিযোগ দিয়েছি ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সাইবার সেলে। ৯৯৯ থেকে দেওয়া দুটি ঠিকানায় অভিযোগ মেইল করেছি। এখনো সমাধান পাইনি। যেহেতু প্রতারকদের ফোন নম্বর ও বিকাশ নম্বর দিয়েছি, আশা করছি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করবে। ডেনিম জ্যাকেটস শপ থেকে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার অপর এক ভুক্তভোগী আসিফুর রহমান সাব্বির বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি  ফেব্রুয়ারি মাসে আমার ৯৮০ টাকা মেরে দিয়েছে। আমার ফোন নম্বরও ব্লক করে দিয়েছে। ওদের পেজে এখন কমেন্টও করতে পারি না। ব্লক করে দিয়েছে।’ এ ছাড়া মুহাম্মদ আবদুর রকিব, তাসরিফ আহম্মেদ জোভানসহ অনেকে প্রতিষ্ঠানটির বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। এ নিয়ে তারা প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্তব্য করেন। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সব মন্তব্য মুছে ফেলা হয়। এদিকে গতকালও ওই পেজটিতে গিয়ে দেখা যায়, এখনো তারা পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে। কেসস্টাডি-২ : বেস্ট কালেকশন বিডি ডট কম (https://www.facebook.com/Best-Collection-BdCom-100634795195521) নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা মূল্যের একটি শাড়ি কিনতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদের অফিসের পারসোনাল বিকাশ নম্বরে (০১৩২১-২৯৫৩০৮) ১ হাজার টাকা পাঠান রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার বাসিন্দা রুকাইয়া ইসলাম। গতকাল তিনি বলেন, শাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছিল। হোম ডেলিভারি পেতে তারা অগ্রিম ১ হাজার টাকা পাঠাতে বলে। ওই পেজে থাকা নম্বরে (০১৯৩৯-৬৭৮৪৫৪) ফোন করে বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘বিশ্বাসের ওপরেই আমাদের ব্যবসা। ১ হাজার টাকায় এক কেজি ইলিশ মাছও হয় না।’ পরদিন সকালে শাড়িটি পাঠানোর কথা ছিল; আজও পাইনি। এখন ফোনও ধরে না। ওই পেজে আমি কোনো মন্তব্যও করতে পারি না। মেসেনজারেও আমাকে ব্লক করে দিয়েছে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্যমতে, বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার এখন ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। সংগঠনটির পরিচালক ও চালডাল লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা জিয়া আশরাফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ই-কমার্সের বিকাশে শুধু লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানই নয়, কেনাকাটায় মানুষের সময় সাশ্রয় হয়েছে। আমাদের চালডাল ডট কম থেকেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতিদিন বিক্রি হয় ৮০ লাখ টাকার পণ্য। ই-ক্যাবের সদস্য আছে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি। এর বাইরেও অনেকে অনলাইনে ব্যবসা করছে। অনেক নারীও ওয়েবসাইট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় পেজ খুলে ব্যবসা করছেন।

প্রতারণা বন্ধ করতে না পারলে সম্ভাবনাময়ী এই খাতটির বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। যারা সততার সঙ্গে ব্যবসা করছেন তাদের প্রতিও আস্থা হারাবে মানুষ। প্রতারকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। ক্রেতাদেরও সচেতন হতে হবে।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনার তিন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশে অনলাইন কেনাকাটা বাড়ে ৫০ শতাংশের বেশি। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছেন প্রায় ৬০ হাজার মানুষ।  দেশের ১৩ লাখ মুদি দোকানও অনলাইন প্লাটফরমে চলে আসছে। ২০২৫ সালের মধ্যে শুধু ই-কমার্স থেকেই আরও ৫ লাখ কর্মসংস্থান হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী সরকার। এই পরিস্থিতিতে প্রতারকদের কারণে ই-কমার্সের আস্থার জায়গা নষ্ট হলে খাতটি বড় ক্ষতির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর