শনিবার, ১৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ভেজাল কসমেটিক্সে বাড়ছে বিপদ

জিন্নাতুন নূর

ভেজাল কসমেটিক্সে বাড়ছে বিপদ

দেশব্যাপী বিভিন্ন কসমেটিক্সের দোকান, অনলাইন শপ ও হাট-বাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভেজাল প্রসাধনীর জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এর ব্যবহার মানবদেহের জন্য গুরুতর বিপদ ডেকে আনছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, নামি-বেনামি বিভিন্ন প্রসাধনী বিশেষ করে রং ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহারের ফলে ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়াও এর ফলে ত্বকের চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া, ত্বকে লোমের পরিমাণ বৃদ্ধি, ত্বকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হওয়া, লোমের গোড়ায় ফোড়াসহ ত্বকে ভাঁজ পড়ে যায়। আশঙ্কার বিষয়, এর ফলে গর্ভবতী নারীর ভ্রুণের স্নায়ু বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানটি মানসিক পঙ্গুত্বের শিকার হয়।

এনভায়রনমেন্টাল এবং সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) এর এক গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের অনেক নামি-দামি প্রসাধনী ব্র্যান্ড তাদের পণ্যে ক্ষতিকর প্লাস্টিক কণা ব্যবহার করে। ‘মাইক্রোবিডস! আনফোল্ড হেলথ রিস্ক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল পলিউটেন্ট’ শীর্ষক গবেষণা থেকে জানা যায়, এর ফলে হৃদরোগ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, স্থূলতা, ত্বকে গর্ত তৈরি হচ্ছে। গবেষণাটির জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে ফেসওয়াশ, বডিওয়াশ, নেইল পলিস, টুথপেস্ট, ফেস ও বডি স্ক্রাবের মতো ৬০টি পণ্য সংগ্রহ করা হয়।

চিকিৎসক ও রসায়নবিদরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানব ত্বকে মেলানিন তৈরি হওয়ায় গায়ের রং কালো হয়। আর রং ফর্সাকারী ক্রিম ত্বকে মেলানিন তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া কিছুটা বাধা দিলেও তা স্থায়ী নয়। সারা পৃথিবীতে কোথাও রং ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করে স্থায়ীভাবে ফর্সা হওয়ার উদাহরণ নেই। অথচ বেনামি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছাড়াই তাদের পণ্য ব্যবহারের পর অনেক ভালো ফলাফল পাওয়ার দাবি করে। দেশে নকল কসমেটিকস তৈরির কারখানা বলা হয় পুরান ঢাকার চকবাজারকে। এখানকার দোকানগুলোতে পণ্যের সমাহার দেখে বোঝার উপায় নেই, এখানেই তৈরি হয় বিশ্বের নামি-দামি সব ব্র্যান্ডের পণ্য। অথচ এই পণ্য তৈরিতে কোনো বৈজ্ঞানিক রীতিনীতির বালাই নেই। সম্পূর্ণ ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে নানা ব্র্যান্ডের প্রসাধনী তৈরি করে যাচ্ছে অনুমোদনহীন বিভিন্ন কোম্পানি। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে প্রসাধনী ব্যবসায়ীরা ভেজাল পণ্য বছরের পর বছর তৈরি করে বাজারজাত করেছেন। চকবাজার থেকে এসব পণ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, বাজারে নকল পণ্য উৎপাদনের পরে সরবরাহ করা হয় তিনভাবে। এর মধ্যে কিছু পণ্য কিনে নেয় পারলার ব্যবসায়ীরা, আর কিছু পণ্য চলে যায় বিভিন্ন মার্কেটে বা ফুটপাথে, আরেকটি অংশ যায় অনলাইনে। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার, তাজমহল টাওয়ারের প্রসাধনী ব্যবসায়ী সাইফুদ্দিন চৌধুরী, তিনি তাকওয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক। চায়না থেকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ৩২ ধরনের প্রসাধনী পণ্যের খালি বোতল আমদানি করতেন সাইফুদ্দিন। পুরনো এবং অবৈধভাবে আমদানি করা এসব খালি বোতল তার অনুমোদনহীন কারখানায় নিয়ে রিফিল করে স্টিকার লাগিয়ে তা আবার বাজারজাত করতেন। এর মধ্যে জনসন বেবি লোশন, বেবি শ্যাম্পু, জনসন পাউডার, ইউনিলিভারের পন্ডস, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীসহ ৩২ ধরনের পণ্যের নকল প্রসাধনী আসল বলে বাজারে বিক্রি হতো। গত ৮ সেপ্টেম্বর চকবাজার থানার মৌলভীবাজারের তাজমহল টাওয়ার ও সোয়ারীঘাটের ৬/১০ চম্পাটুলী লেন এলাকায় র‌্যাব সাইফুদ্দিন চৌধুরীর অনুমোদনহীন কারখানায় অভিযান চালায়।

বিপণিবিতান ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের অসংখ্য পেইজে বিভিন্ন নামি-দামি ব্র্যান্ডের নামে নকল প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। দেখতে আসল প্রসাধনীর মতো মনে হলেও এর বেশির ভাগই রেপ্লিকা বা নকল। ক্রেতারা আসল ভেবে বেশি দাম দিয়ে নকল পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। এর বেশিরভাগ পণ্যে নেই বাংলাদেশ স্ট্যান্টার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর অনুমোদন। বিএসটিআই-এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আমিমুল এহসান বলেন, ভেজাল প্রসাধনীর বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। এরপরও ভেজাল প্রসাধনীর বিক্রি যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে এমন নয়। প্রতারকরা খুব গোপনে গভীর রাতে কাজ করে। এদের খুঁজে বের করতে হলে এদের পেছনে লেগে থাকতে হবে। আর এ জন্য আমাদের বড় জনবলেরও প্রয়োজন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান বলেন, ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারে ভুক্তভোগী হয়ে দুই থেকে তিনজন রোগী প্রতিদিন আমাদের কাছে আসছে। বিশেষ করে ব্রণ, কালো দাগ থেকে মুক্তি, বয়স কমানো ও ফরসা হওয়ার জন্য ব্যবহৃত ক্রিম মেখে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন তারাই বেশি আসেন। সাবধানতা অবলম্বনে তিনি ব্যবহারকারীকে চর্ম বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে প্রসাধনী ব্যবহার করতে বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম ফারুক বলেন, অনলাইন বা প্রসাধনীর দোকানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে তথাকথিত রং ফর্সাকারী ক্রিম। এসব পণ্যে থাকে মার্কারি ও পারদজাতীয় বিভিন্ন উপাদান। আর পারদজাতীয় ভারী ধাতু শরীর থেকে বের হতে পারে না। শরীরে দীর্ঘ সময় অবস্থানের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। পারদ শরীরে ত্বকের ক্যান্সার হওয়া বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়াও হাইড্রোকুইনন ক্রিম (ব্রণের জন্য ব্যবহার হয়) ত্বকের স্বাভাবিক গঠন পরিবর্তন করে। এতে নানা ধরনের সমস্যা থেকে যায়। অর্থাৎ একবার এই পণ্য ব্যবহারের পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অন্য আরও পণ্য ব্যবহার করতে হয়। এ ছাড়াও পারদজাতীয় পণ্য ব্যবহারে গর্ভবতী নারীর ভ্রƒণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে করে ভ্রুণের স্নায়ুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর