বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
দুই বছর ধরে মেয়াদ উত্তীর্ণ ঢাউস কমিটি

খবর নেই বিএনপির কাউন্সিলের

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল হয়, গঠনতন্ত্র উপেক্ষা, নেতারা বলছেন পরিবেশ নেই

মাহমুদ আজহার

খবর নেই বিএনপির কাউন্সিলের

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কাউন্সিলের কোনো খবর নেই। দলটির সর্বশেষ জাতীয় নির্বাহী কমিটির কাউন্সিল হয় ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। আগামী শুক্রবার কাউন্সিলের পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর ৪২ বছরে বিএনপিতে কাউন্সিল হয়েছে ছয়বার। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর পর কাউন্সিল করার বিধান রয়েছে। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় ৫০২ সদস্যের ‘ঢাউস’ কমিটি দুই বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ। আপাতত কাউন্সিল করারও কোনো চিন্তাভাবনা নেই বিএনপির। এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হচ্ছে দলের গঠনতন্ত্র। দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের দাবি, আগামী দিনের আন্দোলন সংগ্রামকে গতিশীল করতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব জরুরি। এক্ষেত্রে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিও পুনর্গঠন করতে হবে। ঢাউস কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে অযোগ্য ও বিতর্কিতদের। কমিটির আকার ছোট করতে হবে। আন্দোলন সংগ্রামে পরীক্ষিত যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের নিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে কেন্দ্রীয় কমিটি। এ জন্য ছোট পরিসরে হলেও কাউন্সিল করার তাগিদ মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের। অবশ্য দলের সিনিয়র একাধিক নেতা জানান, প্রতিকূল পরিবেশের কারণে কাউন্সিল করা যাচ্ছে না। কাউন্সিল করার উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজছেন বলেও জানান তারা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন, ‘করোনার মধ্যেও যতটুকু সম্ভব ঘরোয়াভাবে কাউন্সিল হতে পারে। এতে নতুন নেতৃত্ব বিকাশ লাভ করবে। আমি মনে করি, নামের পাল্লা ভারী করতে দলের ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় ঢাউস কমিটির কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া অর্ধশত উপদেষ্টারই বা দরকার কি? ঢাউস কমিটির অর্থ হচ্ছে, কিছু অযোগ্য, অথর্ব লোককে খুশি করার জন্য কমিটিতে রাখা। এতে দল উপকৃত হচ্ছে না। দল শক্তিশালী না হলে এ ধরনের কমিটির কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সরিয়ে নিয়ে এখন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে নিয়ে যাওয়া উচিত। সেখানে যোগ্য, দক্ষ ও সক্ষম নেতাদের জায়গা করে দেওয়া উচিত।’

বিএনপির মধ্যমসারির একাধিক নেতা বলছেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে অভাবনীয় বিপর্যয়ের পর নেতা-কর্মীদের চাঙা করতে কাউন্সিলের বিকল্প নেই। দলকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আনতেই হবে। এর আগে ৮২টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি পুনর্গঠন হবে। আহ্বায়ক বা আংশিক নয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে হবে। জানা গেছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ১৯। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন। তারা হলেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও এম কে আনোয়ার। এ ছাড়া রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। আর গুম হওয়ার পর ভারতে উদ্ধার হওয়া সালাহ উদ্দিন আহমেদ এখনো দেশে ফিরতে পারেননি। সাজাপ্রাপ্ত বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে কারামুক্ত থাকলেও রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত আছেন। নিজ বাসভবনে তিনি অবস্থান করলেও বিএনপির দাবি, গৃহবন্দী অবস্থায় আছেন। লন্ডনে অবস্থান করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখান থেকেই দলের হাল ধরেছেন। দেশে সক্রিয় আছেন মাত্র ৮ থেকে ১০ জন সদস্য। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানের পাঁচটি পদ ফাঁকা রয়েছে। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছেন, একজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং একজন পদত্যাগ করেছেন। মৃত্যু হওয়ায় দলের চেয়ারপারসনের বেশ কয়েকটি উপদেষ্টা পদও শূন্য রয়েছে। নির্বাহী কমিটির সদস্যসহ ১৫ নেতা মারা গেছেন। এ ছাড়া দল থেকে পদত্যাগ ও পদোন্নতির কারণে নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকটি পদ খালি রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, কাউন্সিল না হলেও ত্যাগী, যোগ্য ও সক্ষম নেতাদের দিয়ে স্থায়ী কমিটিসহ শূন্য প্রায় অর্ধশত পদ পূরণ করা উচিত।  দলীয় সূত্রমতে, ঢাকায় বিএনপিকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগরকে দুই ভাগ করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সভাপতি ও কাজী আবুল বাশারকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ৭০ সদস্যের এবং এম এ কাইয়ুমকে সভাপতি ও আহসানউল্লাহ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা উত্তরের ৬৬ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে দলটি। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হলেও বিভিন্ন জটিলতার কারণে তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুসারে, কমিটিগুলোর ২ বছরের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। অপূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়েই দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা আর প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে খুব বেশি সফলতা দেখাতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে ঢাকার দুই অংশসহ সব মহানগর কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনা করছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গেই কথা বলছেন। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে হবে বলে জানা গেছে। তবে ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতারা বলছেন, কেন্দ্র চাইলে ঢাকা মহানগরের কমিটি যে কোনো সময়ই করতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকা মহানগরের বাসিন্দা যারা ঢাকার অলি-গলি সব চেনেন এমন নেতাদের নেতৃত্বেই কমিটি করা জরুরি। ঢাকার রাস্তাঘাট চেনেন না এমন নেতাদের নেতৃত্বে নিয়ে আসা উচিত নয়। জানা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলা এবং সংশ্লিষ্ট উপজেলা, পৌরসভা ও থানা ইউনিটে বিএনপির পুরনো কমিটি ভেঙে দিয়ে তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ করার নির্দেশনা দেওয়া হলেও বাস্তবে তা হয়নি। করোনায় কয়েক মাস সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন নেতা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় পুনর্গঠন কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়। এরপর সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হলেও দল পুনর্গঠন কার্যক্রমে গতি নেই। এতে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের পাশাপাশি হতাশাও বাড়ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কাউন্সিল একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিভিন্ন জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোও নিয়মানুযায়ী গঠন করা হচ্ছে। কাউন্সিল অবশ্যই হবে। এখন করোনা মহামারী চলছে। আমরা সুবিধাজনক সময়ে কাউন্সিল করব।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। এর একটা কাউন্সিল ভার্চুয়াল বা অনলাইনে হয় না। কাউন্সিল মানে হলো ব্যাপক পরিসরের আয়োজন। প্রায় ৪ হাজারের মতো কাউন্সিলর আছে। তারপরে ডেলিগেট। বিশ্ব পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি আমাদের কখন কাউন্সিল করার সুযোগ দেবে সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে। সাংগঠনিক কার্যক্রম কাউন্সিলের একটা অংশ। আমাদের দেশব্যাপী প্রতিটা জেলা, উপজেলায় যত ইউনিট আছে, সেগুলো কাউন্সিলে পূর্বেই সম্পন্ন করতে হয়। সেই কাজটা আমাদের শুরু হয়েছে।’এক প্রশ্নের জবাবে গয়েশ্বর রায় বলেন, ‘কাউন্সিল দলের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার একটা অংশ, এটা গঠনতন্ত্রেও নিয়ম আছে। গঠনতন্ত্র তো দলের জন্য, জীবনের জন্যই। সেকারণে আমাদের কাউন্সিলটা যে সময় হওয়ার কথা, সে সময়ে হয় নাই, ভবিষ্যতে হবে।’

সর্বশেষ খবর