শুক্রবার, ১৯ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বাবার বৈধ অস্ত্রের ছেলের অবৈধ ব্যবহার

মির্জা মেহেদী তমাল

বাবার বৈধ অস্ত্রের ছেলের অবৈধ ব্যবহার

তোর সঙ্গে আর কে ছিল? কেন খুন করেছিস বল! গোয়েন্দা দফতরের ছোট্ট একটি রুমে জেরা করছেন গোয়েন্দারা। চোখ বাঁধা যুবকটির মুখ খুলছে না। যতবার প্রশ্ন করা হচ্ছে, ততবারই, মাথা নাড়ছে। বিরক্ত গোয়েন্দারা। তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এমন লোক আগে দেখিনি, এক গোয়েন্দা আরেক গোয়েন্দাকে বলছিলেন। পানি, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে কোনো থেরাপি বাদ যায়নি। এর পরও কেন জবাব দিচ্ছে না। এই তুই কেন স্যারের বাসায় গিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছিস! লোকটির কাছে গোয়েন্দার প্রশ্ন। এবার মুখ খোলে চোখ বাঁধা লোকটি। বলে, ‘সত্য। আমি হুমকি দিছিলাম। কিন্তু খুন করিনি। ভয় দেখাচ্ছিলাম স্যার।’ একথা শুনে আরও যেন চিন্তিত হয়ে পড়লেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের প্রশ্ন, তবে খুনি কে? সরকারি গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরি বয়েজ স্কুলের শিক্ষক স্বপন কুমার গোস্বামী খুন হয়েছেন। বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বের হতেই  অস্ত্রধারীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। ধানমন্ডির ভূতেরগলি নর্থ রোডের এই ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০২ সালের অক্টোবরে। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় জড়িতদের ধরতে পুলিশের অভিযান বাড়ানো হয়। শিক্ষকের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর থেকে ধরে নিয়ে আসে ইউনুস মেম্বারকে। জমি নিয়ে বিরোধে এই ইউনুস ঢাকায় এসে এই শিক্ষককে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে গেছে। তার হুমকির কদিন পর শিক্ষক খুন হলে সন্দেহের তীর তখন ইউনুসের দিকে। সেই ইউনুসের কাছে টানা ১৮ ঘণ্টার জেরাতেও পুলিশ কোনো তথ্য পায় না। গোয়েন্দারা তাদের তদন্তের পরিধি বাড়ায়। খুনের ধরনে নিশ্চিত হয়, পেশাদার হিটম্যানের কাজ এটি। কিন্তু পেশাদার হিটম্যানদের কারা ব্যবহার করল? হত্যার জন্যই যে শিক্ষককে গুলি করা হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন? কী এমন করেছেন যে, দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হলো শিক্ষককে! তবে কি নারী ঘটিত কোনো বিষয়? নাকি দ্রুত উন্নতি হওয়ায় জেলাসনেস থেকে স্কুলের কেউ ঘটিয়েছে! এসব প্রশ্নের কোনো জবাব মেলাতে পারছে না গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের কাছে খবর আসে, শিক্ষকের বাসায় ঘটনার আগের দিন সন্ধ্যায় কয়েকজন যুবক আসে। তারা প্রাইভেট পড়ার কথা বলেছে শিক্ষককে। কিন্তু তারা দেখতে ছাত্র মনে হয়নি। এমন কথা শিক্ষক  গোস্বামী বলেছিলেন তার শ্যালককে। এমন সব চিন্তা নিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা যখন ভাবছিলেন, তখনই ফোন এলো। সোর্সের ফোন। ‘স্যার, জিল্লুরের কাছে নতুন লোহা-লক্কড় (রিভলবার) আসছে। ওর গ্রুপের পোলাপানের পকেট ভর্তি মাল (টাকা)। ভালো কাম করছে শুনলাম। খালাস করছে। এমন কথা শুনে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসে। ঠিকানা নেয়। রাতেই অভিযান সেই জিল্লুরের আস্তানায়। পুলিশের ধাওয়ায় পালায় সব। ধরা পড়ে এক সদস্য। নাম রিফাত। গোয়েন্দা দফতরে নিয়ে জেরা শুরু। বেশি জোড়াজুড়ি করতে হয়নি। সব ফাঁস করে দেয় সে। পুলিশ আর সময় নেয় না। রিফাতের দেওয়া তথ্যে অভিযান চলে। ধরা পড়ে শান্তনু আর আপন। এরা একই স্কুলের ছাত্র। শান্তনুর বাবা সরকারি কর্মকর্তা। এই দুই ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ খুনের তথ্য পায়। পুলিশ শুনে হতবাক। পুলিশের জেরায় শান্তনু জানায়, স্যারকে হত্যা করতে দেড় মাস আগে পরিকল্পনা করি। কারণ স্যার আমাকে নকলের দায়ে পরীক্ষা থেকে এক্সপেল করে। আর আপনকে স্কুল থেকে বের করে দেয়। আমরা আর সহ্য করতে পারছিলাম না। শান্তনু বলে যায়, স্যারকে খুন করতে সন্ত্রাসী জিল্লুরের কাছে আমি নিয়ে যাই। স্যারকে খুন করতে জিল্লুরকে ১ লাখ টাকা দেব বলে প্রস্তাব দেই। কিন্তু জিল্লুর বলে, পাক্কা দেড় লাখ লাগব। এর কম হইব না। আমি এক লাখের ওপর পারব না জানিয়ে দেই। জিল্লুর বলে, ১ লাখের কিছু বেশি দিতে হবে। কারণ অস্ত্র ভাড়া করতে হবে। তখন আমি বলি, আমার বাবা সরকারি কর্মকর্তা। উনার লাইসেন্স করা রিভলবার আছে। ওটা দেব। জিল্লু রাজি হয়। বাসা থেকে রিভলবার নিয়ে এসে দেই জিল্লুরের কাছে। এর কয়েকদিন পর কাজ হয়ে যায়।’ জিল্লুর গ্রুপের সদস্য রিফাতের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, তারা শিক্ষকের বাসার কাছে আগে থেকে ওতপেতে থাকে। সকাল ৯টায় শিক্ষক বাসা থেকে বেরিয়েই একটা দোকানের সামনে দাঁড়ান। উনি সিগারেট নিচ্ছিলেন। এ সময় তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আমাদের দিকে তাকাতেই আমরা স্যারকে সালাম দেই। এরপরই গুলি চালাই। পরে ফাঁকা গুলি করতে করতে পালিয়ে যাই। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিচারিক আদালত দুজনের ফাঁসি এবং একজনের যাবজ্জীবন দন্ড দেয়।

সর্বশেষ খবর