শনিবার, ২০ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

আমি মাইরা ফালাইছি পুলিশ ডাকেন

মির্জা মেহেদী তমাল

আমি মাইরা ফালাইছি পুলিশ ডাকেন

ইডেন কলেজের ছাত্রী মোহসিনা রব্বানী। ডাক নাম মেনকা। দুপুরের পর মেনকার মা হাসিনা বেগম খেয়ে-দেয়ে নিজের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েন। কলেজ থেকে ফিরে মেনকা তার নিজ রুমে বই পড়ছিলেন। হঠাৎ মেনকার আর্তচিৎকারে হাসিনা বেগমের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি উঠে দেখেন, বসার ঘর খালি। মেনকার ঘরের দরজা বন্ধ। ততক্ষণে আর্তনাদ থেমে গেছে। তিনি ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে তা খুলতে বলেন। জানালা দিয়ে ভিতরে দেখার চেষ্টা করেন। আঁতকে উঠেন হাসিনা বেগম। একি! ভিতরে ছোরা হাতে কে দাঁড়িয়ে? আরে ওতো কবির! তার হাতে রক্তাক্ত ছুরি কেন?

মেনকা কোথায়? মুহূর্তেই তার মাথায় নানা প্রশ্ন। জবান বন্ধ। রক্তাক্ত ছুরি হাতে কবির শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘মেনকা আর নেই। আমি মাইরা ফালাইছি। আপনি পুলিশ ডাকেন। পুলিশ না আইলে আমি দরজা খুলব না।’ ২০১০ সালের ১৫ জুলাইয়ের বিকালে খুন হন ইডেন কলেজের ছাত্রী মেনকা। মিরপুর মধ্য পাইকপাড়ার ২৯/২/এ নম্বরের বাসায় তাকে এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। খুনির নাম কবির। তিনি মেনকার দূরসম্পর্কের মামা। খবর পেয়ে পুলিশ আসে। কবিরকে গ্রেফতার করে। পুলিশের জেরার মুখে কবির জানিয়েছেন, ‘মেনকা আমার সঙ্গে বেইমানি করেছে। আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু সে আমার কোনো কথাই শোনে না। তাই, ফরিদপুরে আমি একটি ছোরা বানাতে অর্ডার দেই। ছোরার নকশা আমি নিজেই তৈরি করে দেই। সেই ছোরা নিয়ে চলে আসি ঢাকায়।’

পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েই এ ঘটনা ঘটিয়েছেন কবির। তাকে ঘটনাস্থল থেকেই গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ব্যবহƒত রক্তাক্ত ছুরিটি। এরপর হাসিনা চিৎকার শুরু করলে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন। মিরপুর থানায় ফোন করা হয়। পুলিশ আসার পর দরজা খুলে দেন কবির। ততক্ষণে মেনকা আর বেঁচে নেই। ঘরের এক কোনায় পড়ে ছিল তার রক্তাক্ত নিথর দেহ। ঘটনাস্থলে প্রথমে পৌঁছানো পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, তিনি পুলিশের লোক হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পর কবির দরজা খোলেন। উপস্থিত উত্তেজিত লোকজন তখন তার ওপর হামলে পড়েন। তবে পুলিশ তাকে সরিয়ে ফেলে। প্রতিবেশীরা বলেছেন, মেনকার ঘরের দরজা লোহার তৈরি হওয়ায় তা ভাঙা সম্ভব হয়নি।

অনুতাপ ছিল না খুনির : খুনের পর একদম নির্বিকার ছিলেন কবির। মিরপুর থানায়ও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যায়নি। থানায় তিনি বলেছিলেন, ‘এখনো এ কাজের জন্য আমার খারাপ লাগতেছে না। যা করছি, ভালোই করছি। ও (মেনকা) আমার সঙ্গে বেইমানি করছে।’ কবির দাবি করেছেন, তার সঙ্গে একসময় মেনকার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে মেনকা তাকে এড়িয়ে চলছিলেন। পুলিশের তদন্তে জানা যায়, খুনের এক সপ্তাহ আগে কবির এ খুনের পরিকল্পনা করেন। এ জন্য ফরিদপুর থেকে অর্ডার দিয়ে ছুরি তৈরি করেন। সিঙ্গাপুর যাওয়ার মিথ্যা কথা বলে দেখা করতে মেনকাদের বাড়িতে যান। হাতে থাকা ট্রাভেল ব্যাগের ভিতরেই ছিল ছুরি। মেনকার ঘরে গিয়ে মেনকাকে বিয়ের চাপ দিলে একপর্যায়ে একজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়েছে বলে জানায় মেনকা। এতে ক্ষেপে যায় কবির। হাতে ছুরি নিয়ে মেনকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কবিরের দাবি, ২০০৪ সাল থেকে মেনকার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। ২০০৭ সালে কবির মালয়েশিয়ায় যান। ২০০৯ সালে ফেরার পর আবারও তাদের সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়। কিন্তু কিছুদিন থেকে সম্পর্ক রাখতে অস্বীকার করতে থাকেন মেনকা। মেনকার স্বজনরা জানান, তাদের জানা মতে, কবিরের সঙ্গে মেনকার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কেউ কখনো এ রকম ধারণাও করেননি, এখনো বিশ্বাস করেন না।

বিচার : ইডেন কলেজের ছাত্রী মহসিনা রাব্বানী মেনকা হত্যা মামলার আসামি তারিকুজ্জামান কবিরকে ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১০ সালের ১৫ জুলাই রাজধানীর মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ার বাসায়  মেনকাকে হত্যা করে কবির। হত্যাকান্ডের প্রায় এক বছর পর ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক মো. রেজাউল ইসলাম আসামির উপস্থিতিতে রায় দেন। রায় শুনে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো কবিরের কোনো ভাবান্তর দেখা না গেলেও কান্নায় ভেঙে পড়েন আদালতে উপস্থিত মেনকার বাবা লুৎফে রব্বানী এবং মা হাসিনা রব্বানী। হত্যাকান্ডের পর মেনকার বাবা মিরপুর মডেল থানায় কবিরকে আসামি করে মামলা করেন। ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। দন্ডিত কবির মেনকার খালা জেসমিনের দেবর। তাদের বাড়ি ফরিদপুরে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর