সোমবার, ২২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

দ্রুত সংক্রমণ বাড়াচ্ছে ইউকে ভেরিয়েন্ট

দেশে করোনার ৩৪টি ইউনিক মিউটেশন, শনাক্ত ২১৭২, মৃত্যু ২২

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্রুত সংক্রমণ বাড়াচ্ছে ইউকে ভেরিয়েন্ট

দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অধিক সংক্রমণশীল করোনাভাইরাসের ইউকে ভেরিয়েন্ট। ফলে আবারও হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণ। বাড়ছে মৃত্যু। ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ হার ৩ শতাংশের নিচে নেমে এলেও মার্চে আবারও ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২ হাজার ১৭২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ঢিলেঢালা স্বাস্থ্যবিধি ও যুক্তরাজ্যের অধিক সংক্রমণশীল স্টেইনটি (পরিবর্তিত ধরন) বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় আবারও করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। ভাইরাসটির আগের স্টেইন ১০০ জনকে সংক্রমিত করতে পারলে ইউকে ভেরিয়েন্ট সংক্রমণ ছড়ায় ১৭০ জনের মধ্যে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ২১ হাজার ১০৮টি নমুনা পরীক্ষায় ২ হাজার ১৭২ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। এই সময়ে মারা গেছেন ২২ জন। সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ৬৮৭ জন। রোগী বাড়ায় আবারও পূর্র্ণ হয়ে যাচ্ছে করোনা হাসপাতালের শয্যাগুলো। গতকাল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যার চেয়ে ১২০ জন বেশি করোনা রোগী ভর্তি ছিল। ঢাকার ১৯টি কভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে তিনটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা গতকাল খালি ছিল না। গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হয় অধিক সংক্রমণশীল নতুন স্টেইন। ভাইরাসটি তান্ডব চালায় যুক্তরাজ্যজুড়ে। আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউকে ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা আগের ভেরিয়েন্টের চেয়ে ৭০ ভাগ বেশি। অর্থাৎ, আগের ধরনটি ১০০ জনকে সংক্রমিত করতে পারলে নতুন ধরনটি সংক্রমণ ছড়ায় ১৭০ জনের মধ্যে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি শনাক্ত সব রোগীর চিকিৎসা ও আইসোলেশন নিশ্চিত করা। ইউকে ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া রোগীরা কাদের সংস্পর্শে গেছে তাদের শনাক্ত করে কোয়ারেন্টাইনে রাখা। বদ্ধ ঘরে জমায়েত করে অনুষ্ঠান সীমিত করা। দেশে করোনার ৩৪টি ‘ইউনিক মিউটেশন’ : বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো করোনার ৩৪টি ইউনিক মিউটেশন (নতুন ধারার পরিবর্তন) শনাক্ত করা হয়েছে। সার্স কভ-২ এর জিনোমে পাওয়া গেছে নতুন ধারার এ পরিবর্তন।  ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ভাইরাসের জিনোমে দেখা গেছে ৪ হাজার ৬০৪ রকমের ভিন্নতা। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন দেখা যায়নি। বাংলাদেশের গবেষকরা এ মিউটেশনগুলোর নাম দিয়েছেন ‘বাংলা মিউটেশন’। এ মিউটেশনের সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র পরিবর্তন দেখা গেছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে। দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ‘বাংলাদেশে করোনার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক জিনগত পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উদ্ঘাটন করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, গবেষকরা দেশের ৩৭১ জনের জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে ‘গ্লোবাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্স অ্যান্ড রেসপন্স সিস্টেম’ শীর্ষক তথ্য বিশ্লেষণ করেন।  আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা ‘এলসেভিয়ার’ এবং নেদারল্যান্ডসের ‘ভাইরাস রিসার্চ’ জার্নালে গতকাল গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. মাহবুব হাসান, ড. আদনান মান্নান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউএসটিসি) শিক্ষক রাসেল দাশ। গবেষণা তত্ত্বাবধানে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এস এম মাহবুবুর রশিদ ও ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জুনায়েদ সিদ্দিকি। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে ছিলেন মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হামিদ হোসাইন ও নাজমুল হাসান এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসমা সালাউদ্দিন, রাশেদুজ্জামান ও মেহেদী হাসান।

এতে গত বছরের এপ্রিল-ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ডাটাবেস ‘গ্লোবাল ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্স অ্যান্ড রেসপন্স সিস্টেম’ এ জমাকৃত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ ও সম্পূর্ণ জিনোম সিকুয়েন্সগুলো নিয়ে গবেষণায় বাংলাদেশি সার্স কভ-২ এর জিনোম বিন্যাসের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সার্স কভ-২ এর জিনোম সিকুয়েন্সের তুলনা করা হয়েছে। বায়োইনফরমেটিক্স ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজির বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে গবেষণাটি করা হয়। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে ভাইরাসের ডি ৬১৪জি অংশের মিউটেশন বা পরিবর্তন যেখানে যেখানে দেখা গেছে, সেসব জায়গাতেই জিনগত পরিবর্তনের হার অনেক বেশি। এই পরিবর্তনটিই হয়তো ২০২০ সালের মাঝামাঝি দেশে সংক্রমণের হার বেশি থাকার অন্যতম কারণ হতে পারে। এ ছাড়াও নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র জিনগত পরিবর্তন পাওয়া গেছে বাংলাদেশে। গবেষক দলের প্রধান ড. আদনান মান্নান বলেন, এ মিউটেশন বা জিনগত ভিন্নতার কারণে ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না তা খতিয়ে দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো বিশেষ উপসর্গের পেছনে এ রকম ইউনিক বা বাংলাদেশে স্বতন্ত্র মিউটেশনগুলো দায়ী কিনা, কিংবা এ ধরনের মিউটেশন থাকলে রোগীরা উপসর্গবিহীন হয় কি না সেটাও দেখা প্রয়োজন। কারণ ‘নিউ মাইক্রোবস আন্ড নিউ ইনফেকশন’ নিবন্ধে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেশে আনুপাতিক হারে উপসর্গবিহীন কভিড-১৯ এর রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই দেশের নতুন জিনগত মিউটেশনগুলোর বিরুদ্ধে সম্প্রতি উদ্ভাবিত ও প্রয়োগকৃত টিকা কার্যকর কি না তা গবেষণা করা জরুরি।

ইউএসটিসির শিক্ষক রাসেল দাশ বলেন, ‘গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি দিক হলো, বাংলাদেশের ইউনিক মিউটেশনগুলো খুব অঞ্চলভিত্তিক। যেমন কিছু কিছু জিনগত পরিবর্তন শুধু নির্দিষ্ট কিছু জেলা বা অঞ্চলেই দেখা গেছে। ঢাকায় তিনটি সুনির্দিষ্ট জিনগত পরিবর্তন দেখা গেছে, যেটা শুধু ঢাকার রোগীদের মধ্যেই ছিল, অন্য কোথাও দেখা যায়নি। একইভাবে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, বরিশাল, যশোর, মৌলভীবাজার ও ময়মনসিংহতে এ রকম একদমই নিজস্ব জেনেটিক ভিন্নতা ছিল। এ ক্ষেত্রে সেসব জেলার ভৌগোলিক অবস্থান, জীবনযাপন এবং পরিবেশগত নিয়ামকগুলো হয়তো ভাইরাসকে বদলে দিতে ভূমিকা পালন করছে।’    

গবেষণার সমন্বয়কারী চবি শিক্ষক মাহবুব হাসান বলেন, ‘এতগুলো ইউনিক মিউটেশন থাকলে দেশে নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট বা প্রকরণ উদ্ভব হওয়ার খুব বড় একটা সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে গবেষণাগারে দ্রুত এসব মিউটেশন বহন করা ভাইরাসগুলো নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। দেখা উচিত তা কি ব্রিটিশ কিংবা আফ্রিকান ভেরিয়েন্টের সদৃশ বাংলাদেশি বা বাংলা ভেরিয়েন্টের মতো কোনো নতুন প্রজাতির ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না। দিলেও আদৌ তা সংক্রমণশীল কিংবা ভয়াবহ কি না।

গবেষণায় বলা হয়, দেশে সবচেয়ে বেশি নতুন ধারার জিনগত পরিবর্তন তথা ইউনিক মিউটেশন পাওয়া যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে (তিনটি করে)। সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময় জিনোম সিকুয়েন্স পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এখানে একই সঙ্গে সৌদি আরব তথা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলের ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্সের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাইরাসের জিনোমগুলোর মাঝে মিল পাওয়া গেছে। দেশে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ অঞ্চলের সদৃশ জিনোম সিকুয়েন্সের ভাইরাস। এ ছাড়াও পৃথিবীব্যাপী সার্স কভ-২ এর যে পরিবর্তনটিকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংক্রমণশীল বলে বিবেচনা করা হয়েছে, সেই জি ৬১৪ডি মিউটেশন ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি সিকুয়েন্সের মধ্যেই ছিল।

সর্বশেষ খবর