শিরোনাম
সোমবার, ২২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বিদেশ থেকে এলো ভাড়াটে খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

বিদেশ থেকে এলো ভাড়াটে খুনি

রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শামীম সরণি। সেখানকার একটি বাড়ির চতুর্থতলার ফ্ল্যাট থেকে শেকল বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বেডরুমের মেঝের ওপর পড়ে ছিল লাশটি। মুখবন্ধ স্কচটেপে। ফ্ল্যাটটি বাইরে থেকে তালা লাগানো ছিল এবং দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। পুলিশ ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকে। ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে লাশটি উদ্ধার করা হয়। ভবনের মালিক থাকেন কলাবাগানে। পুলিশকে তিনি বলেছেন, মাসুদ নামের এক ব্যক্তি ডিসেম্বরেই বাসাটি ভাড়া করেন। পুলিশ প্রায় নিশ্চিত, খুন করতেই বাসাটি ভাড়া করা হয়েছে। পুলিশ লাশের সন্ধানে মাঠে নামে। গোয়েন্দারা রাজধানীর প্রতিটি থানায় লাশ উদ্ধারের        মেসেজ পাঠিয়ে দেয়। কেউ নিখোঁজ হয়েছেন, এমন কোনো তথ্যের জন্যই এই মেসেজ পাঠানো। কিন্তু কোনো থানাতেই নিখোঁজের কোনো মেসেজ নেই। লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। পত্র-পত্রিকায় পরদিন অজ্ঞাত এই ব্যক্তির লাশের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একটি ফ্ল্যাটে শেকলে বাঁধা এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের সংবাদটি সারা দেশে তখন আলোচিত। পত্র-পত্রিকায় সংবাদের পর লাশের পরিচয় মিলে। তিনি হলেন, রমনা থানা জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা ইসহাক। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর কাহিনি। এই খুনে বিদেশ থেকে দেশে আনা হয় দুজন ভাড়াটে খুনিকে।

পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মাসুদ রানা পরিচয়ে এক ব্যক্তি বাড়ির কেয়ারটেকার আতিকুল ইসলামের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। সে সময় ভাড়াটিয়া মাসুদ কেয়ারটেকারকে জানান, কানাডা থেকে তার বোন-দুলাভাই এসে এই ফ্ল্যাটে থাকবেন। ১৯ ডিসেম্বর মাসুদ ফ্ল্যাটে ওঠেন। কিন্তু নিহত এই ব্যক্তিকে তিনি চেনেন না। পাঁচ দিন ধরে ওই ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ ছিল। পরে দুর্গন্ধ বের হলে স্থানীয় লোকজন পুলিশে খবর দেয়। এ ব্যাপারে পুলিশ মামলা করে। মাসুদ খুন করতেই ছদ্মনামে এই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন। অজ্ঞাত ওই ব্যক্তিকে বাইরে থেকে এনে হত্যা করার পর সে বাইরে দরজায় তালা মেরে পালিয়ে যায়, পুলিশের ধারণা এরকমই ছিল। ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর ইমাম মো. ইসহাককে অপহরণ করা হয়। রমনা এলাকা থেকে তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। সেখান থেকে সোজা শেওড়াপাড়ার ফ্ল্যাটে। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। পরে পত্রিকার মাধ্যমে অজ্ঞাতনামা এক লাশের খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ইসহাকের লাশ শনাক্ত করেন তার ভাই শুয়াইব। পরে তিনি অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে রমনা থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে প্রতিবেদন পেশ করে। ইমাম ইসহাকের আত্মীয় ইলিয়াস মোল্লা চট্টগ্রামে তার লবণের কারখানা মালয়েশিয়া প্রবাসী আবদুর রহিমের কাছে বিক্রি করেন। মূল্য পরিশোধ করা সত্ত্বেও ইলিয়াস কারখানা রেজিস্ট্রি করে না দিলে এতে আপসের চেষ্টা করেন ইমাম ইসহাক। তিনি নিজেও প্রবাসী রহিমের কাছে টাকা পেতেন। লবণ ফ্যাক্টরির মধ্যস্থতা ও ইমাম ইসহাকের পাওনা টাকা না দেওয়ায় তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। একপর্যায়ে মালয়েশিয়া প্রবাসী আবদুর রহিম ইমাম ইসহাককে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। আর এ জন্য তিনি মালয়েশিয়া থেকে ভাড়াটে খুনি দেশে নিয়ে আসেন। তবে এই খুনি দুজন বাংলাদেশি। ভাড়াটে খুনি ইকরাম ওরফে মাসুদ ও মুরাদ হোসেন মালয়েশিয়া থেকে দেশে এসে ইমাম ইসহাককে অপহরণ করে। তারা বায়েজীদ ও নাজিমুদ্দিনের সহায়তায় ইমাম ইসহাককে অপহরণের পর হত্যা করে। হত্যার পর এই দুই খুনি নিরাপদেই দেশ ছাড়েন।

 

মামলার বিচার : মাওলানা ইসহাক হত্যার দায়ে চারজনের মৃত্যুদন্ড ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দেয় আদালত। ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মোতাহার হোসেন এ রায় দেন। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন আবদুর রহিম সরদার (৪৩), কাজী বায়েজীদ (৪২), ইকরাম খান ওরফে মাসুদ ওরফে নাঈম খান (৪৫) ও মুরাদ হোসেন (৪৫) এবং যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন মো. নাজিমুদ্দিন (৪০)। তবে ইমাম হাফেজ মাওলানা ইসহাক (৫০) হত্যা মামলার দুই আসামিকে খালাস দেয় হাই কোর্ট। এ ছাড়া তিন আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়। মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকরের অনুমতি ও জেল আপিলের শুনানি করে হাই কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর  হোসেন এবং মো. ইমদাদুল হক আজাদের বেঞ্চ এই রায় দেয় ২০১৩ সালে। মো. কাজী বায়েজিদ (৪২), মুরাদ হোসেন (৪৫) ও ইকরাম ওরফে মাসুদের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত। এদের মধ্যে মুরাদ ও ইকরাম পলাতক রয়েছেন। বাকিরা কারাগারে রয়েছেন।

ইন্টারপোলের রেড নোটিস : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা ইসহাক হত্যার পরিকল্পনাকারী মালয়েশিয়া প্রবাসী ও ঘাতক ইকরাম হোসেন নাঈম এবং মুরাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে ইন্টারপোলের সদস্যভুক্ত ১৮৮ দেশে রেড নোটিস পাঠিয়েছে।

সর্বশেষ খবর