বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

মোবাইল ফোনের একটি বাক্স চিনিয়ে দিল খুনিকে

মির্জা মেহেদী তমাল

মোবাইল ফোনের একটি বাক্স চিনিয়ে দিল খুনিকে

একটি ডেইরি ফার্মের কর্মচারী ফিরোজ আলম হঠাৎ করেই নিখোঁজ। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ। খবর পেয়ে গ্রাম থেকে ছেলের কর্মস্থল কেরানীগঞ্জে ছুটে আসে তার বাবা-মা। পুলিশকে জানায়। কিন্তু পুলিশও ফিরোজ নিখোঁজের কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় ফিরোজের অবস্থানও জানতে পারে না পুলিশ। পুলিশের কাছে ধরনা দিতে দিতে              ফিরোজের পরিবার হয়রান। ফিরোজের বাবা-মা বিছানায় পড়ে গেছেন। পুলিশও কোনো আশার আলো দেখতে না পেয়ে তদন্ত কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। কোথাও কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছে না। সবকিছুই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। ফিরোজের কর্মস্থলের লোকজন যথারীতি কাজে ব্যস্ত। বাবা-মা শুধু কাঁদে ছেলেকে না পেয়ে। পুলিশও মোবাইল ফোনের কোনো সূত্র খুঁজে পায় না। ফিরোজের মোবাইল ফোনের কোনো কাগজপত্র যদি পাওয়া যায়, সেটিও কাজে লাগতে পারে বলে পুলিশ ফিরোজের বাবাকে জানিয়েছে।

২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবরের ঘটনা। ওই ডেইরি ফার্ম থেকে ফিরোজ আলম নিখোঁজ হন। পরদিন ফার্মের মালিক মো. তোফায়েল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পুলিশ দীর্ঘদিন চেষ্টার পরও ফিরোজের কোনো সন্ধান পায়নি। নিখোঁজের পরপর তার ব্যবহƒত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফিরোজের বাবা তাদের বাড়ির উঠোনে একটি মোবাইল ফোনের বাক্স দেখতে পান। সেটি তার নজরে পড়লে পুলিশের সেই কথাটা তার মনে পড়ে। পুলিশ তাকে বলেছিল, মোবাইল ফোনের কাগজপত্র পাওয়া গেলেও তদন্তে কাজে লাগবে। ফিরোজের বাবা সেই বাক্সটি নিয়ে পুলিশের কাছে দেয়। পুলিশ যা খুঁজছিল তা সেখানে পেয়ে যায়। অর্থাৎ মোবাইল ফোনের যন্ত্র শনাক্তকরণ (আইএমইআই) নম্বরটি বাক্সের ভিতরের একটি কাগজে ছিল। ঘটনার ৯ মাস পর পুলিশ এমন নম্বর পেয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু করে। তদন্তে নাটকীয় মোড় নেয়।

ওই নম্বর অনুযায়ী মোবাইল ফোনের ব্যবহারকারীকে শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ফোন বন্ধ থাকায় শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। এর কদিন পর ফোনটি চালু পাওয়া যায়। সিআইডি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওই ফোনের অবস্থান জানতে পারে। তারা দেখেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের কাংশাপুর গ্রামে তারা অবস্থান করছে। সেখান থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী হিসেবে দীন ইসলামকে আটক করে সিআইডি। দীন ইসলাম হলো ফিরোজের কলিগ। তারা একসঙ্গেই কাজ করত ডেইরি ফার্মে। ফিরোজের নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পর সে চাকরি ছেড়ে চলে যায়। নিখোঁজ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো. শবজেল হোসেন দীনকে গ্রেফতার করে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় নিয়ে যান। জিজ্ঞাসাবাদে দীন হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে। ফিরোজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী তার মোবাইল ফোনটিই খুনের রহস্য খুলে দেয়। ধরিয়ে দেয় তার মালিকের খুনিকে। দীর্ঘ ৯ মাস পর মাটি খুঁড়ে উদ্ধার হয় ফিরোজের হাড়গোড়, পরনের শার্ট-লুঙ্গি। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে নিখোঁজের ৯ মাস পর এভাবেই ফিরোজের কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। চিহ্নিত হয় খুনি। খুনি তার বন্ধু দীন ইসলাম। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানায়, মোবাইল ফোনের যন্ত্র শনাক্তকরণ (আইএমইআই) নম্বর ব্যবহার করে খুনিকে শনাক্তের পর গ্রেফতার করা হয়।

 

দীন ইসলাম পুলিশকে জানায়, গদারবাগ এলাকায় ওই ডেইরি ফার্মে তারা দুজন কাজ করত। বয়সে দুজনে সমান হওয়ায় বন্ধুর মতো ছিল। সারা দিনের অফিসের কাজ শেষে ফিরোজের মোবাইল ফোন নিয়ে দুজনে মারামারি করত। আবার কিছুক্ষণ পর মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ত। ঘটনার দিনও ঠিক দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে দীন ফার্মে থাকা লোহার রড দিয়ে ফিরোজকে আঘাত করে। এতে ফিরোজ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও ফিরোজের জ্ঞান ফেরাতে পারেনি দীন। এ সময় দীন কী করবে ভেবে না পেয়ে ফার্মের ভিতর যে রুমে তারা ঘুমাত, সে রুমের মাটি খুঁড়ে লাশ চাপা দিয়ে রাখে। দুই-তিন মাস খুঁজে যখন ফিরোজকে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন কৌশলে চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যায় দীন। ফিরোজ আলমের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার বদরপুর গ্রামে। বাবার নাম বিল্লাল হোসেন। অন্যদিকে অভিযুক্ত দীন ইসলামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানার কাংশাপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল হোসেন। তারা দুজন কেরানীগঞ্জ মডেল থানার গদারবাগ এলাকায় একটি ডেইরি ফার্মে চাকরি করত। পুলিশ জানায়, হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে দীন ইসলাম বিস্তারিত জানিয়েছে পুলিশকে। সে কারাগারে।

সর্বশেষ খবর