রবিবার, ২৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

নকল ও ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব

অভিযানেও বন্ধ হচ্ছে না

মাহবুব মমতাজী

নকল ও ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব

দেখতে একই রকম। মোড়ক, দাম ও আর পণ্য-কোথাও তেমন পার্থক্য নেই। তবে একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, যে কোনো ব্র্যান্ডের নামের শেষের শব্দে কিংবা দ্বিতীয় শব্দটি ভিন্ন দিয়ে উচ্চারণে সামান্য পার্থক্য আনা হয়েছে। এভাবে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে নামি ব্র্যান্ডের মোড়কে নকল পণ্য বাজারজাত করছিল একটি চক্র। চক্রটির তিনজনকে গত ১৫ মার্চ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। যাত্রাবাড়ীতে এমন আরও তিনটি কারখানার সন্ধান পেয়েছে সংস্থাটি।

শুধু সিআইডিই নয়, গত এক মাসে অন্তত সাতটি ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব। এসব অভিযানে ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপরও থেমে নেই নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অধিক মুনাফার জন্যই কিছু চক্রের নকল ও ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব হয়েছে। র‌্যাব সূত্র জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে তারা ১ হাজার ৪৫৬টি ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৬২টি। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ২৪ কোটি ৪৫ লাখ ৯০ হাজার ৯৪৪ টাকা। আর জেল-হাজতে পাঠানো হয়েছে ১ হাজার ২৫২ জনকে। তবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে গত বছর অভিযানের সংখ্যা ছিল কয়েক গুণ বেশি। গত বছর ৮৫১টি অভিযানে মামলা হয়েছিল ৩ হাজার ৩৪টি।

সিআইডির গত ১৫ মার্চের অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে জাহিদুল ইসলাম, আবদুর কাদের ও ইউনুছ আলী। এ সময় তাদের কাছ থেকে নকল পণ্য তৈরির মেশিন এবং প্রায় ১৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা মূল্যের সরঞ্জাম ও পণ্য জব্দ করা হয়। অভিযানে নেতৃত্বে থাকা সংস্থার পরিদর্শক খান মো. এরফান জানান, গ্রেফতার ওই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা আরও তিনটি কারখানার খোঁজ পেয়েছেন।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, নকল পণ্যের প্যাকেটের রং ও অন্যান্য তথ্য একই। গভীরভাবে যাচাই না করলে ভোক্তারা এটি ধরতে পারবেন না। তাদের পণ্য যে নকল তা বোঝার সুযোগ ছিল না ভোক্তাদের। এমনকি দোকানিরাও তা ধরতে পারতেন না।

সিআইডি ও র‌্যাব সূত্র জানায়, বিস্কুট, চানাচুর, কফি, চকোলেট, চিপস, আইসক্রিম, বোতলজাত তরল পানীয়, নুডলস, বোতলজাত সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, মশার কয়েলসহ অনুমোদনহীন নানা পণ্য দেদার বিক্রি হচ্ছে বাজারে। দেশের নামি ব্র্যান্ডগুলোর মোড়কের আদলে কাছাকাছি নাম দিয়ে এসব পণ্য কিনতে গিয়ে সহজে বুঝতেও পারেন না ক্রেতা। পুরান ঢাকার চকবাজার, বংশাল, যাত্রাবড়ী, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, আদাবর, গাবতলী, মিরপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান এলাকায় এসব নকল পণ্য উৎপাদনের কারখানা গড়ে উঠেছে। এমনকি ক্যাডবেরি ব্র্যান্ডের ডেইরি মিল্কের নাম নকল করে অনেকেই চকোলেট উৎপাদন করছে। অবৈধভাবে এই ডেইরি মিল্কের নামে চকোলেট বানানো গ্রিন নাইন নামে একটি কোম্পানির বিপুল পরিমাণ নকল পণ্য জব্দ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ডেইরি মিল্ক একমাত্র ক্যাডবেরির নিজস্ব স্বত্ব। অন্যসব ডেইরি মিল্ক না। এ ছাড়া কোনো পণ্যের গায়ে যদি কারখানার পুরো ঠিকানা না থাকে তাহলে পণ্যটি ভুয়া কোম্পানির। এদের কারখানাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্যানুযায়ী, বাজারে প্রতিষ্ঠিত অনেক ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর লেবেল ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নেই। এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৫ ভাগ প্রসাধন পণ্যের বিএসটিআইর সনদ নেই, ৭৫ ভাগ পণ্যের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নেই। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ এ প্রতিবেদককে জানান, কিছু অসাধু চক্র অধিক মুনাফার জন্য নকল পণ্য উৎপাদন করে। অধিক মুনাফা এবং অতিরিক্ত চাহিদার জন্যই নকল পণ্য উৎপাদন বন্ধ নেই। তবে আমাদের ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং রমজান সামনে রেখে এই অভিযান আরও জোরদার করা হবে। জানা গেছে, গত ১০ ফেব্রুয়ারি কাফরুলের দক্ষিণ ইব্রাহিমপুর স্বাধীনতা চত্বরের কাছে একটি বাসায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানে ভেজালবিরোধী অভিযান চালায় র‌্যাব। ভেজাল খাদ্যপণ্য তৈরি, সংরক্ষণ ও বিক্রির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আলী আজগরকে ৬ লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত ১২ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজার ও কামরাঙ্গীরচরে অভিযান চালিয়ে তিনটি নকল প্রসাধনী তৈরির কারখানাকে ১৯ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় কারখানা তিনটি থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের নকল ও ভেজাল প্রসাধনী জব্দ করা হয়েছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকায় চারটি নকল প্রসাধনী তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে ১৪ লাখ টাকা জরিমানাসহ চারজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় প্রায় ৫০ লাখ টাকার নকল প্রসাধনী সামগ্রী জব্দ করা হয়। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে নকল সিরামিক, ওয়াশিং পাউডার, ভেজাল খাবার তৈরি ও বিক্রির অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও ডেমরার পাঁচ কারখানায় অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযান শেষে ৭ লাখ টাকা জরিমানা ও দুটি কারখানা সিলগালা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত ২২ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারে মেসার্স নিধি কসমেটিক্সের কারখানায় অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে ৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি সিলগালাসহ বিপুল পরিমাণ প্রসাধনী সামগ্রী জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাট এলাকায় নকল খাদ্যপণ্য উৎপাদন করায় দুজনকে সাজা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত ৪ মার্চ ঢাকার কেরানীগঞ্জে ভেজাল ও মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার উৎপাদন করায় চারটি প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় একটি কারখানা সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান চারটি থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কেজি মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার জব্দ করে তা ধ্বংস করা হয়। গত ৭ মার্চ কদমতলী ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় অনুমোদনহীন নকল বৈদ্যুতিক তার উৎপাদন, মজুদ ও বিক্রি করার অভিযোগে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ৩৭ লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় চারজনকে তিন মাস করে কারাদন্ড দেওয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর