শিরোনাম
বুধবার, ৩১ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

পাসপোর্ট আর ভিসায় মেলে খুনির পরিচয়

মির্জা মেহেদী তমাল

পাসপোর্ট আর ভিসায় মেলে খুনির পরিচয়

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ এক সকালে ভয়ংকর এক সংবাদ পেল। পূর্ব হাটিলা গ্রামে আপন দুই বোন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের অবস্থা এমনই খারাপ হয়েছিল যে, দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কিন্তু বড় বোনকে অনেক চেষ্টাতেও বাঁচানো যায়নি। ঘটনার তিন দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। সংবাদটি ফোনে শুনে থানার ইন্সপেক্টর আলমগীর হোসেন আঁতকে ওঠেন। কী বলেন এসব! একটি গ্রামে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, অথচ আমরা কিছুই জানতে পারলাম না!

চাঁদপুরের আবদুস শহীদ। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দুবাই থাকেন। বছরে দুবার দেশে আসেন। তার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থাকে। মেজো মেয়ে রিবার বিয়ে হয়েছে আট মাস আগে। বিয়ের কয়েক মাস পরই তার স্বামী হযরত দুবাই চলে যান। এ কারণে বাবার বাড়িতেই থেকে যান রিবা। ছোট বোন রেখা, রিবা আর তাদের মা, বাড়িতে এই তিনজনই থাকেন। সংসারে এই তিনজনের সব ঠিকঠাক যাচ্ছিল। রিবা ছোট বোন রেখাকে খুব আদর করে। দুবাই প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে রিবার প্রায়ই কথা হয় ফোনে। মাঝে মধ্যে রেখাও বলে। রেখা ফোনে দুলাভাইয়ের সঙ্গে দুষ্টামি করে। তাদের বাবাও প্রায় প্রতিদিন ফোন করে তাদের খোঁজখবর নেয়। জামাই আর শ্বশুর দুবাই থাকলেও তারা একসঙ্গে সেখানে নেই। দুই শহরে দুজনের কাজ। কিন্তু হঠাৎ এক রাতের আকস্মিক ঝড়ে সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায়। পুলিশ ইন্সপেক্টর আলমগীর ফোর্স নিয়ে পৌঁছে যায় আবদুস শহীদের বাড়িতে। বাড়ির উঠোনে রিবার লাশ। অস্বাভাবিক এক নীরবতা। পাড়া-পড়শির ভিড়। পুলিশ কর্মকর্তা বাড়ির এদিক সেদিক ঘুরে দেখছে। আশপাশ লোকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও কেউ মুখ খুলছে না। এক বাড়ির দুটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলো। এক বোন পৃথিবী থেকে বিদায় নিল ঘটনার তিন দিন পর। এমনই এক পরিস্থিতিতে পুলিশ কর্মকর্তা রেখার রুমে যায় কথা বলতে। কিন্তু পারে না। রেখা চুপচাপ বসে আছে ঘরের এক কোনে। তার অবস্থা ভালো না হলেও সে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছে বাড়িতে। রুম থেকে বেরিয়ে যান আলমগীর। শহীদ সাহেব শোকে দিশাহারা। মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে দুবাই থেকে চলে এসেছেন। এক মেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল, অন্য জনের (রেখার) অবস্থাও ভালো না। বাড়ি ফিরেছে রিবার স্বামী হযরত। সেদিন সকালেই সে দেশে ফিরেছে দুবাই থেকে। প্রিয়তমার এমন মৃত্যুতে সেও শোকে বিহ্বল। রিবার নাম ধরে ডাকছিল, আর হাউমাউ করে কাঁদছিল। মাত্র আট মাস আগে বিয়ে করেছে। তার কান্না দেখে উপস্থিত কেউ চোখের পানি আটকাতে পারছিল না। শ্বশুর-শাশুড়ি জামাইকে ধৈর্য্য ধরতে বলছেন। বাড়ির এ অবস্থায় পুলিশ ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যান।

সেই রাতে পাড়া-পড়শিদের কেউ কিছু দেখেছে কিনা, তা জানার চেষ্টা করেন আলমগীর। আশপাশের লোকজনকে আবারও জিজ্ঞাসা করে। ইন্সপেক্টর আলমগীর এসব কথা ছোট নোট বুকে টুকে নেয়। তবে আলমগীর যতটুকু জানতে পেরেছে পাড়াপড়শিদের কাছ থেকে তাতে করে সে নিজে খুশি হতে পারছে না। রেখা স্বাভাবিক হওয়ার পরই তার কাছ থেকে ঘটনা জানবে বলে সিদ্ধান্ত নিল আলমগীর।

আলমগীর আবারও শহীদ সাহেবের বাড়িতে ঢুকে। ঠিক ওই সময়ে লাশের গোসল করানোর প্রস্তুতি চলছিল। আলমগীর তখন বলে, এক মিনিট। এখন গোসল নয়। লাশ একটু দেখার দরকার রয়েছে আমাদের। আমরা যখন বলব, তখন গোসল হবে। পুলিশের এমন কথার পর গোসলের লোকজন চলে গেল। ইন্সপেক্টর লাশটি মুহূর্তেই দেখে নিলেন। আরেক পুলিশ সদস্যকে বললেন, সুরতহাল তৈরি কর। এরপরই বারান্দায় একটি চেয়ারে গিয়ে বসলেন পুলিশ কর্মকর্তা আলমগীর। মা, তুমি কি এখন সুস্থ বোধ করছ? রেখাকে জিজ্ঞাস করে আলমগীর। হ্যাঁ, একটু সুস্থ। বাবার পাশে বসা রেখা জবাব দেয়। রেখা বলে, মা ঢাকায় ছিলেন। ডাক্তার দেখাতে সেদিনই যান। বাসায় ছিলাম আমি আর রিবা আপু। পাশের ঘরে আমি পড়ছিলাম। হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পাই। এরপরই আপুর চিৎকার। আমি দৌড়ে যাই আপুর রুমে। দেখি আপু মেঝেতে পড়ে আছে। পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞাসা করেন, তোমার মেজো আপু ছাড়া ঘরে আর কাউকে দেখেছ তুমি? কেউ বের হচ্ছে বা ঢুকছে কিনা। এমন কাউকে? মনে পড়ে? না দেখিনি। দেখে মনে হলো, পা পিছলে পড়ে গেছে আপু। এ সময় মাথায় বা শরীরের নাজুক কোনো স্থানে আঘাত পেয়ে ওই অবস্থা হয়েছে। তাহলে তোমাকে তখন অন্য রকম লাগছিল কেন? কারও সঙ্গে কথা বলতে পারনি কেন? রেখাকে থামিয়ে আলমগীর প্রশ্ন রাখে। রেখা বলে, আপু আমাকে মায়ের মতো আদর করে। আপুকে দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। প্রথমতো ভেবেছি, আপু মনে হয় মারা গেছে। কারণ এমন ভাবে পড়ে ছিল, শ্বাস-প্রশ্বাস বুঝতে পারিনি। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। খলিল কাকারা (প্রতিবেশী) যখন এলো, তখন কী বলেছি তাদের, আমি মনে করতে পারছি না। কিন্তু ঘটনা এখন আমার ঠিক মনে পড়ছে। যা বললাম, সেই রাতে তাই ঘটেছিল।

এমন কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচল পুলিশ কর্মকর্তা আলমগীর। ভাবে, তার মানে ধর্ষণের কিছু ঘটেনি। মৃত্যুটাও দুর্ঘটনা। মানুষ যেভাবে গুজব ছড়ায়, মিথ্যাটাও সত্যি মনে হতে থাকে। একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে গেল ভয়ংকর ঘটনা।

পুলিশ কর্মকর্তা এবার কথা বলেন রেখার বাবা শহীদ সাহেবের সঙ্গে। শহীদ সাহেব বলেন, স্যার রেখাও আমাকে একই কথা বলেছিল। মামলা করে কী হবে। দুর্ঘটনার ঘটনা। এ সময় পাশে বসে থাকা রিবার স্বামী হযরতও মামলার বিপক্ষে। হযরত লাশের গোসল করাতে বলে। দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু পুলিশের এক কথা। গোসল এখন হবে না। লাশের ময়নাতদন্ত হবে। তারপর গোসল দাফন। তার আগে নয়। গ্রামের লোকজন চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘পয়সা খাওয়ার ধান্দা এটা, পুলিশ জাত, মরা মানুষও ছাড়ে না।’ রিবার স্বামী হযরতও তাদের সঙ্গে সুর মেলায়। রিবার বাবাও বাদ থাকে না। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও অনুরোধ করে পুলিশকে। পুলিশ কর্মকর্তা আলমগীর একরোখা। ময়নাতদন্ত করতেই হবে। কী আর করা, অতঃপর পরিবারের অমত সত্ত্বেও জিডি করে ময়নাতদন্তের জন্যে লাশ পাঠানো হলো মর্গে। যদিও পরিবার নানা আপত্তি করেছিল, একরোখা পুলিশ ইন্সপেক্টর তা শুনলেন না।

পরদিন ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হলো। ময়নাতদন্তের সময়েই জানা যায়, রিবার বুকের একটা হাড় ভাঙা। প্রচ- চাপে এভাবে হাড় ভাঙে। গলায় নখের আঁচড়ের দাগ। আঁচড়ের এমন গভীরতা হয় ধস্তাধস্তি হলেই। ময়নাতদন্তে এসব তথ্য উঠে আসে। এবার রিবার মৃত্যুটি আর নিছক কোনো দুর্ঘটনা থাকল না। রিবার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে ইন্সপেক্টর আলমগীর। সামান্য খুঁজতেই জানতে পারলেন কিছু অস্বাভাবিক তথ্য। স্বামী হযরতের সঙ্গে রিবার সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। মাত্র আট মাসের বিবাহিত জীবনে তাদের মাঝে হঠাৎ দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। ঝগড়া বিবাদ হয় কয়েকবার। এরই মাঝে দুবাই চলে যায় হযরত। এমন তথ্যগুলো ভাবিয়ে তোলে আলমগীরকে। রিবার কোনো প্রেমিকের নাম বা অস্তিত্ব খুঁজে পায় না আলমগীর।

সেদিন রাতে বাসায় ফিরেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন আলমগীর। মনটা তার ভালো না। এমন সময় সোর্সের ফোন। সোর্স কবির বলে, স্যার, রিবার স্বামী হযরত তো আপনাকে বলেছিল, সে রিবার মৃত্যুর দিন দেশে ফিরেছে। আমি জানতে পারলাম, যে রাতে ঘটনা ঘটেছে, সেই রাতেই হযরতকে দেখা গেছে। তাকে তার বোনের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে আমার এক লোক। ও বলল, হযরত খুব তারাতারি করে বোনের বাসায় ঢুকছিল। ঢোকার সময় সন্দেহজনক ভাবে আশপাশে তাকাচ্ছিল। অদ্ভুৎ খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে শোয়া থেকে এক লাফে উঠে বসেন আলমগীর। হযরতকে চোখে চোখে রাখতে বলে লাইন কাটে আলমগীর। কীভাবে সম্ভব! হযরতের সেদিনের কান্না আলমগীরের মনে পড়ে যায়। এমন ভাবে কেঁদেছিল সেদিন হযরত, নির্ভেজাল ভালোবাসার প্রমাণ মেলে। সকাল থেকেই নতুন উদ্যোগে তদন্ত শুরু করল আলমগীর। প্রথমেই হযরতের খোঁজ নেয়। অনেক খোঁজার পর দুই দিন বাদে দেখা মিলে হযরতের। পুলিশ হযরতের বোনের বাসায় যায়। ইন্সপেক্টর আলমগীর তার সঙ্গে খোশগল্পে মজে যান। হযরত দুবাই কোথায় থাকে, কী কাজ করে-এসব নানা খুঁটিনাটি বিষয় জেনে নেয়। চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা আলমগীর বলে, আমার এক ছোট ভাই দুবাই যাবে। পাসপোর্টে ভিসা পড়েছে। কিন্তু আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। আপনার পাসপোর্টের ভিসাটা দেখতে পারলে সন্দেহটা কেটে যেত। এ কথা শুনে হযরত বলে, আরে স্যার, অবশ্যই। আমি পাসপোর্ট নিয়ে আসছি। কিছু সময় পর হযরত আসে। হাতে পাসপোর্ট। এগিয়ে দেয় আলমগীরের কাছে। আলমগীর তার পাসপোর্টে ভিসা দেখে। দেশে ফেরার তারিখ দেখে নেয়। তার সোর্স কবির সঠিক তথ্যই দিয়েছে। হযরত এসেছে ঘটনার দিন সকালে। কিন্তু সে বলেছিল, ঘটনার তিন দিন পর সে দেশে এসেছে, যেদিন রিবার মৃত্যু হলো। আলমগীরের ঠিক উল্টো পাশেই বসা হযরত। আলমগীর পাসপোর্টে দেশে ফেরার তারিখ দেখেই হযরতকে ফিসফিস করে বলতে থাকে, হযরত, আমার সঙ্গে তোমাকে এখন থানায় যেতে হবে। কেন থানায় যাব-হযরতের প্রশ্ন। কেন যাবা সেটা পড়ে বুঝতে পারবা। ভালোভাবে যদি না যাও, তবে তোমার কোমড়ে দড়ি বেঁধে পেটাতে পেটাতে থানায় নিয়ে যাব। কোনটা চাও তুমি। তোমার চয়েজের ওপর ছেড়ে দিলাম। হযরত বুঝতে পারে। পুলিশ কিছুটা টের পেয়ে গেছে। সে বলে, স্যার চলেন। হযরতকে নিয়ে থানায় যান আলমগীর। সেখানে তাকে জেরা করা হয়। হযরত মুখ খুলতে থাকে। এরপর পুলিশ নিয়ে আসে রেখাকে। পুলিশ তাকে জানায়, সব কথা বলে দিয়েছে হযরত। আতকে উঠে রেখা। সেও মুখ খোলে। বলে, বিয়ের পর থেকেই রিবা আপু আর দুলাভাইয়ের সম্পর্ক ভালো ছিল না। এরই ফাঁকে দুলাভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয় আমার। সম্পর্ক এতটাই গাঢ় হয় যে, তা শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়। বিষয়টা কেউই আঁচ করতে পারেনি। দুই মাস আগে হযরত দুবাই যাওয়ার পর থেকেই আমি একাকিত্ব সহ্য করতে পারছিলাম না। রেখা জানায়, তাকে বিয়ে করতে হবে। প্রয়োজনে রিবাকে সরিয়ে দিতে হবে।

রেখা জানত ঘটনার দিন বাড়িতে কেউ থাকবে না। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, হযরতকে দুবাই থেকে ডেকে আনে সে। সঙ্গোপনে খুলে দেয় ঘরের দরজা। প্রথমে দুজন প্রণয়ে লিপ্ত হয়। এরপর ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে যায় রিবার ঘরে। অঘোরে ঘুমাচ্ছিল রিবা। প্রথমেই ওড়না দিয়ে রেখা বেঁধে ফেলে রিবার পা। তারপর চেপে বসে রিবার ওপর। আর হযরত রিবার মুখে বালিশ চাপা দেয়। এতেও কিছু না হলে গলা টিপে ধরে সে। ধস্তাধস্তির সময় ভেঙে যায় বুকের হাড়। একবার একটা চিৎকার দিতে পেরেছিল সে। আর সুযোগ হয়নি তার। এর পরের ঘটনা সবার জানা। ঘটনাটি ২০১৮ সালের অক্টোবরের।

সর্বশেষ খবর