বৃহস্পতিবার, ১ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

মাদক মামলায় দায়মুক্তির হিড়িক

আরাফাত মুন্না

মাদক মামলায় দায়মুক্তির হিড়িক

রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছ থেকে কাজল মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে ৩০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর মিরপুর মডেল থানার এএসআই আবু জাফর বাদী হয়ে মামলা করেন, মামলা নম্বর-৪(১২)১৩। রাসায়নিক পরীক্ষায়ও জব্দ করা ট্যাবলেটগুলোকে ইয়াবা বলে নিশ্চিত করা হয়। পরে তদন্ত শেষে কাজল মিয়াকে মামলার একমাত্র আসামি দেখিয়ে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। চার্জশিটে সাক্ষী করা হয় আটজনকে। সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায় থেকে এক রকম বিনা বিচারেই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন কাজল মিয়া। কিশোরগঞ্জের মো. হারুন নামের এক ব্যক্তিকে ২০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ২০১৪ সালে আটক করে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানার এসআই আতিকুর রহমান বাদী হয়ে মামলা করেন, মামলা নম্বর-৪৩(৮)১৪। রাসায়নিক পরীক্ষায়ও ট্যাবলেটগুলো ইয়াবা বলেই নিশ্চিত করা হয়। মামলার তদন্ত শেষে একমাত্র আসামি হারুন মিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। বাদীসহ আটজনকে সাক্ষী করা হয় এ মামলায়ও। এ মামলাটিতেও একইভাবে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায় থেকে অব্যাহতি মেলে একমাত্র আসামি হারুনের।

মামলা দুটিতে ঢাকার পৃথক দুই আদালতের দেওয়া অব্যাহতি আদেশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৯ ধারায় এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হলো। আসামিকে রিলিজ প্রদান করা হলো। এই দুই মামলায় থাকা ১৬ সাক্ষীর মধ্যে পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। পাঁচজনই সমন না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেন, সমন পেলে অবশ্যই সাক্ষ্য দিতে হাজির হতাম।

শুধু এ মামলা দুটিই নয়, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে মাদক মামলার আসামিরা বিনা বিচারে পার পেয়ে যাচ্ছে বলে               তথ্য মিলেছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি সাক্ষীর অভাবে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায় থেকেই আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এমন শতাধিক মামলার তালিকা পুলিশ হেড কোয়াটার্স ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। ওই তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীর ঘটনাগুলোর মধ্যে অধিকাংশ আসামিই অব্যাহতি পেয়েছেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত থেকে। আদেশে আদালত রাষ্ট্রপক্ষকে ব্যর্থ বললেও দায় নিতে নারাজ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। পুলিশের ওপর দায় চাপিয়ে তারা বলেন, প্রসিকিউশনই শুধু রাষ্ট্রপক্ষ না। পুলিশও রাষ্ট্রপক্ষের অংশ। সাক্ষী হাজির করার দায়িত্বও তাদের। এদিকে আইনজ্ঞরা বলছেন, সাক্ষী হাজির না করতে পারা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতম দিক। সাক্ষী হাজির না হওয়ার কারণে অধিকাংশ সময়ই আসামি খালাস পেয়ে যায়। তাই যথাযথ সাক্ষীদের হাজির করার বিষয়টি কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ার কারণে অনেক সময়ই মামলা টেকে না। এটা আসলে আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতম দিক। যথাযথ সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ার কারণে সার্বিকভাবে তিন-চতুর্থাংশ ফৌজদারি মামলার আসামি খালাস পেয়ে যায়। পুলিশ সাক্ষী নিজে উপস্থিত হওয়া এবং অন্য সাক্ষীকে উপস্থিত করা, এই বিষয়ে কঠোর নজরদারি না থাকার কারণে ফৌজদারি মামলাগুলো অর্থহীন হয়ে যায়। তাই সাক্ষী হাজির করার বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে বলে মন্তব্য করেন শাহদীন মালিক।

সাক্ষীরা যা বলেন : কাজল মিয়ার [৪(১২)১৩] মামলার চার সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। এরা হলেন- মামলার বাদী ও এক নম্বর সাক্ষী এএসআই আবু জাফর, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবদুল আজিজ, দুই কনস্টেবল দিলীপ ও শাহীন ফকির। এর মধ্যে আবু জাফর বর্তমানে রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় কর্মরত আছেন। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশকে না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি আদালতের সমন পেলেই সাক্ষ্য দিতে যেতাম। তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল আজিজ বলেন, বর্তমানে আমি কিশোরগঞ্জে আছি। সাক্ষ্য দিতে যাওয়ার জন্য এ মামলায় কোনো সমন পাইনি। দুই কনস্টেবল দিলীপ বর্তমানে রয়েছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানায় এবং শাহিন ফকির বর্তমানে খুলনার রেলওয়ে পুলিশে কর্মরত। দুজনই সমন না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে মো. হারুনের [৪৩(৮)১৪] মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. আসলাম আলী বর্তমানে রাজধানীর সবুজবাগ থানায় কর্মরত। এ মামলায় সাক্ষী দিতে গিয়েছিলেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সমন পেলে আমি সাক্ষ্য দিতে যাই। তবে এ মামলার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।

সংশ্লিষ্টরা যা বলেন : সাক্ষী হাজির করতে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ, আদালতের এমন আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ বলতে শুধু প্রসিকিউশনকে বুঝায় না। পুলিশও রাষ্ট্রপক্ষের একটি অংশ। মূলত সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সমন বাস্তবায়ন করে। তাই পুলিশের সাক্ষীদের হাজির করার দায়িত্ব পুলিশকেই নিতে হবে।

বাহিনীর সাক্ষীদের হাজিরের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হায়দার আলী খান বলেন, আদালত থেকে সমন অথবা কোনো নির্দেশনা পুলিশের কাছে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করা হয়। এরপরও যদি কারও বিরুদ্ধে নিয়ম ভঙ্গ করার খবর পাওয়া যায়, তাহলে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর