বৃহস্পতিবার, ১ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বাদী-খুনি ছিল একসঙ্গে

মির্জা মেহেদী তমাল

বাদী-খুনি ছিল একসঙ্গে

সালাম তার স্ত্রী রুশনী আর একমাত্র মেয়ে রুলিকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে। নৌকায় চড়ে। হাওর বিল পাড়ি দিয়ে ফিরতে হচ্ছে। শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। আঁধার নামছে। নৌকা তখন মাঝ হাওরে। ভয় পায় রুলি। সালাম বুঝতে পারে মেয়ের চেহারা দেখে। হাসিখুশি মেয়ের মুখে কেমন একটা আতঙ্কের ছাপ। সালাম তাকে নির্ভয় দেয়। উল্টো পথে নৌকা আসছে দুটো। খুব জোরে। আবদুস সালামের নৌকা চলছে। সালামের দৃষ্টি সামনে দিয়ে আসা নৌকা দুটির ওপর। এই মাঝি, নৌকা পাশে নেও একটু! দেখছ না সামনে দিয়ে কত জোরে নৌকা দুটি আসছে-নিজের নৌকার মাঝিকে বললেন সালাম। সালামদের মাঝি তখন পাড় ঘেঁষে নৌকা চালাতে থাকে। উল্টো দিকের দুটো নৌকা দিক পাল্টে পাড় ঘেঁষে আসতে থাকে। একদম সামনে চলে এসেছে ওই দুটি নৌকা। সামনের নৌকাটি এসে সালামদের নৌকায় ধাক্কা দিল। সালামদের মাঝি এবার চিৎকার করে বলছে, কী ব্যাপার, নৌকা সরায়ে ফেল। সালাম ভালো করে দেখতে পায়, ৪/৫ ব্যক্তি সেই নৌকায়। তাদের মুখ ঢাকা গামছা দিয়ে। হাতে তাদের লাঠিসোঁটা। সালাম নিশ্চিত হয়, তারা বিপদে পড়েছে। ডাকাত দলের মুখোমুখি এখন তারা। তাদের নৌকায় লোকগুলো উঠতে শুরু করছে। সালাম বাধা দেয় আর বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকে। রুশনী আর মেয়ে রুলি ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করছে। কিন্তু হাওরে তাদের চিৎকার মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসের তোড়ে। আশপাশে জনমানবের চিহ্ন বলতে কিছু নেই। হামলাকারীরা লাঠি দিয়ে সালামকে পেটাতে থাকে। মেয়ে বাবাকে রক্ষা করতে গেলে তাকেও মারধর করা হয়। সালাম তার মেয়েকে সরে যেতে বলে। চিৎকার করে মাঝিকে বলে, ও মাঝিভাই, তুমি আমার স্ত্রী আর মেয়ের প্রাণ বাঁচাও। আমি আছি এখানে। সালামের মাথা দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। ওই অবস্থায় ডাকাতদের জাপটে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। তারা যেন স্ত্রী আর মেয়ের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার পণ নিয়েই যেন ডাকাতদের ধরে রেখেছে সালাম। বাবার মাথায় রক্ত দেখে জ্ঞান হারায় মেয়ে রুলি। ডাকাত দল সালাম আর তার মেয়েকে ধরে হাওরে ফেলে দেয়। রুশনী তখন ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নৌকা থেকে। মাঝিও নৌকা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরাতে থাকে। কোনো রকমে সাঁতরে রুশনী পাড়ে আসতে পারে। ব্যাগ ভিজে গেছে। তাড়াতাড়ি খুলে সেখান থেকে মোবাইল ফোন বের করে তার ভাইকে কল করে। ‘ও ভাইজান! সর্বনাশ হইছে। নৌকায় ডাকাত ধরেছে। আমি নৌকা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে পাড়ে উঠছি। রুলি আর তোমাদের জামাইকে ওরা নৌকা থেকে ফেলে দিছে। ভাইজানগো আমি এখন কী করব।’ কান্না করতে থাকে রুশনী। সেই রাতেই রুশনীর ভাইয়েরা ট্রলার নিয়ে চলে আসে। তারা রুলি আর তার বাবা সালামের খোঁজ করতে থাকে। কিন্তু রাতে বাবা আর মেয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। সারা রাত রুশনী আর তার ভাইরা সেখানেই থাকে। রাতের আঁধার কেটে চারদিক ফরসা হতে থাকে। খবর পেয়ে আশপাশের গ্রামের লোকজন দলে দলে আসতে থাকে। গ্রামবাসীরা ট্রলারে করে তল্লাশি চালায় হাওরে। আসে পুলিশও। তারাও তল্লাশি চালাতে থাকে। কিন্তু খোঁজ পাওয়া যায় না বাবা মেয়ের। রুশনীর গগনবিদারী আহাজারিতে সেখানকার বাতাস তখন ভারী হয়ে ওঠে। তাকে কেউ সান্ত্বনা দিতে পারে না। বেলা ১১টার দিকে প্রথমে সালাম মিয়া ও কিছু সময় পর মেয়ে রুলি বেগমের লাশ পানিতে ভেসে ওঠে। স্থানীয়রা ট্রলার নিয়ে খোঁজ করার সময় লাশ দুটি ভাসতে দেখে। সেখান থেকে টেনে তুলে পাড়ে নিয়ে আসে বাবা-মেয়ের লাশ দুটি। স্বামী আর মেয়ের লাশ ধরে রুশনী বেগমের কান্নায় যেন প্রকম্পিত হতে থাকে চারদিক। সে তখন পাগলপ্রায়। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পশ্চিমে পাথর চাউলি হাওরে সালাম মিয়া ও তার মেয়ে রুলি বেগমের মৃত্যুতে গ্রামের লোকজনও সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। এ ঘটনার এক দিন পর রুশনী বেগম তার ভাসুর এবং আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন কোম্পানীগঞ্জ থানায়। রুশনী বেগমের অভিযোগ, এ ঘটনার পেছনে সালামের বড় ভাই এবং পরিবারের আরও কয়েকজন জড়িত। সম্পত্তি আত্মসাতের জন্যই আপন ছোট ভাইকে তারা হত্যা করেছে। তারা পালিয়ে যায়। তাদের কাউকে গ্রেফতার করতে না পারায়, খুনের রহস্য বের করতে পারে না পুলিশ। গ্রামের লোকজন রুশনী বেগমের পক্ষে। ভাসুর ও পরিবারের লোকজনের ওপর তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ। জমিজমা আত্মসাতের জন্য বড় ভাই হয়ে ছোট ভাই ও তার মেয়েকে এভাবে মারতে পারে? ওই পরিবারকে গ্রামবাসী একঘরে করে রেখেছে। গ্রামবাসী পুলিশকে বলেছে, সালামের বড় ভাইকে তারা পেলে ধরে পুলিশকে খবর  দেবে। কিন্তু কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশ খুন সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য কোথা থেকেও খুঁজে পায় না। পেশাদার অপরাধীদের সঙ্গেও পুলিশ যোগাযোগ করেছে। হাওরে খুনের মতো জঘন্য অপরাধ কেউ করেছে কি না, তা জানার চেষ্টা করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। খুনিরা গ্রেফতার না হওয়ায় সালামের স্ত্রী রুশনী বেগম পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ। কয়েক মাস পর এই মামলার তদন্তের ভার থানা পুলিশের কাছ থেকে চলে যায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর হাতে। নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ইন্সপেক্টর  আবুল হোসেন একজন ঝানু অফিসার। এই গ্রাম সেই গ্রাম, তার পথচলা যেন শেষ হতে চায় না। হাটবাজারেও চলে যান কোনো কাজের উছিলায়। ছদ্মবেশ নেন। দু-একবার ফেরিওয়ালা হয়েছেন। কখনো সিগারেট বিক্রেতা, কখনো হাঁড়ি পাতিল বিক্রেতা। নৌকার মাঝি হয়ে হাওরে ভেসে চলেছেন। তার মাথায় শুধু সালাম-রুলি খুনের রহস্য।

মখন মিয়া। তদন্ত করতে গিয়ে তিনজনের কাছ থেকে এই নামটি শুনেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এখন পর্যন্ত তার কাছে এই নামটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। যে কজনের নাম তিনি পেয়েছেন, দ্বিতীয়বারের মতো তাদের নাম কেউ বলেনি। এ কারণে ইন্সপেক্টর আবুলের এখন টার্গেট মখন মিয়া। এই নামের মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না পুলিশ। তবে আবুল হোসেন একটা বিষয় নিশ্চিত হতে পেরেছেন, এই জোড়া খুন কোনো ডাকাতির ঘটনা নয়। তদন্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন ছোটেন কোম্পানীগঞ্জের একটি মদের ডেরায়। তিনি বেশ কয়েকজনকে ভালো করে খেয়াল করে দুজনকে টার্গেট করেন। ওই দুজনের সামনে বসে পড়েন আবুল। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা দুজনের মধ্যে একজন বলে ওঠে, মখন মিয়ারে পাওয়া যায় কম। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আছে। তারা বলতে পারবে মখন মিয়ার খবর। আঁধারে যেন আলোর ঝলকানি দেখতে পেলেন ইন্সপেক্টর আবুল। কান খাড়া করে রাখেন। আবারও মখন মিয়ার কথা তোলেন আবুল হোসেন। এবার দুই ব্যক্তির একজন বলে ওঠেন, আরে গনু মিয়া আর ইলিয়াসরে জিজ্ঞাস করলেই পাবেন। বেশি সময় লাগেনি। ইন্সপেক্টর আবুলের প্রশ্নবাণে জর্জরিত গনু মিয়া ইলিয়াস গরগর করে সব বলে দিল।

ইলিয়াস মিয়া বলে, ‘মখন মিয়া আমার বন্ধু। আট মাস আগে মখন মিয়া আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল হাওরে কাজের কথা বলে। সেখানে গিয়ে দেখি নৌকায় সালাম মিয়া তার পরিবার নিয়ে ফিরতেছিল। পরিচিত মানুষ। ভালো লোক। কিন্তু মখন মিয়ার কথায় বাধ্য হয়ে তাকে মারতে হয়েছে। তার মেয়েকেও। বউটার প্রাণ বাঁচছে। তবে কী নিয়ে কাজটা করল, তা তো জানি না। মখন মিয়ারে প্রশ্ন করছি-সালামরে কেন মারলা? জবাব দেয় নাই। শুধু বলে, এত কিছু জানার দরকার নাই। আমি তখন চুপ মাইরা যাই।’

খুনের প্রায় আট মাস পর পুলিশ এই জোড়া খুনের একটা কিনারা করতে যাচ্ছে। ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ উত্তরপাড়ার চান মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। পুরো বাড়ি পুলিশ প্রথমে ঘিরে ফেলে। দরজার কড়া নাড়ে। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। দরজা না খোলায় ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। ধাক্কাতে ধাক্কাতে একটা সময় দরজা ভেঙে ফেলে পুলিশ। ঘরের মধ্যেই পেয়ে যায় মখন মিয়াকে। এক কোনায় বসে আছে। পুলিশ ঢুকে পড়ায় সে উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে আসে একদম পুলিশ কর্মকর্তা আবুলের সামনে। ‘আমাকে খুঁজছেন কেন স্যার’-জানতে চায় মখন। পুলিশ ইন্সপেক্টর আবুলের মুখে হাসির ঝলক। বলে, তোকে খুঁজছি কেন, পরে বুঝতে পারবি। অনেক হয়েছে, এখন চল আমাদের সঙ্গে। মখন মিয়ার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেন ইন্সপেক্টর আবুল। মখনকে টেনে বের করতেই হঠাৎ থেমে যান আবুল হোসেন। আবুলের চোখ ঘরের ভিতরে। আরে রুমের ভিতর তো আরও একজন আছে! মহিলা! অন্ধকারে ভালো করে দেখতে পাননি প্রথমে। হাতের টর্চলাইটের আলো মহিলার মুখে ধরে। আঁতকে ওঠেন পুলিশ কর্মকর্তা আবুল হোসেন। পরিচিত মুখ! তাকে দেখে ভিমরি খাওয়ার অবস্থা ঝানু এই পুলিশ কর্মকর্তার। তিনি কি ভুল দেখছেন? চোখ বড় করে ভালো করে তাকান। না, ঠিকই তো দেখছেন তিনি। এই মহিলা সকালেও তার কাছে এসেছিলেন। তার স্বামী সালাম মিয়ার খুনিদের গ্রেফতার কতদূর-তা জানতে। তার স্বামীর খুনিদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাব তাকে দিতে দিতে রীতিমতো হয়রান হয়ে গেছেন ইন্সপেক্টর আবুল। সেই মহিলাকে পাওয়া গেল খুনি মখন মিয়ার রুমে! খুনি মখনের সঙ্গে কী করছিল রুশনী?  ইন্সপেক্টর আবুলের বুঝতে আর বাকি থাকে না কিছু। ইন্সপেক্টর আবুলের কাছে এখন সব পরিষ্কার। সেই মহিলার দিকে তাকিয়ে আবুল বলেন, ও আচ্ছা, তাহলে এই খবর? আপনি তো মখনের চেয়ে বেশি ভয়ংকর একজন মানুষ। পরকীয়ায় মজে স্বামী-সন্তানকেই খুন করিয়ে দিলেন? পুলিশের এমন কথায় মাথা নিচু করে থাকে রুশনী বেগম, সালামের স্ত্রী। মামলার বাদীও রুশনী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর