নেত্রকোনার আটপাড়ার দৌলতপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান জুনায়েদ। বয়স বারো। তার বড়ভাই হাফেজ রাকিবুল ইসলাম। জয়দেবপুরের নয়াপাড়া মনিপুর রাহিমা খাতুন হাফিজিয়া মাদরাসার শিক্ষক। জুনায়েদ থাকে ভাইয়ের কাছে। ভাইয়ের মতোই হাফেজ হওয়ার ইচ্ছা তার। মাদরাসায়ই থাকে। তার রাতের খাবার আসে ওই গ্রামেরই মোশাররফ হোসেন মিয়ার বাড়ি থেকে। জুনায়েদ নিজেই প্রতিরাতে খাবার নিয়ে আসে। শিক্ষক রাকিবুল ইসলাম মাদরাসায় ‘করপোরাল পানিশমেন্ট’ (অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রদের শারীরিক শাস্তি) চালু করেছিলেন।
২০১২ সালের ডিসেম্বর মাস। কনকনে শীত। হাড়কাঁপানো ওই শীতের এক রাতে ভাত আনতে যেয়ে ফিরেনি জুনায়েদ। ভাত নিয়ে আসার সময় পথেই নির্মমভাবে খুন হয়। খুনিরা পাশের আখ খেতে লুকিয়ে ছিল। সেই রাতে জুনায়েদ একা ছিল না। সঙ্গে সহপাঠী সৌরভ ছিল। সৌরভ সৌভাগ্যবান। সেও মার খেয়েছে। দৌড়ে সে মাদরাসায় চলে আসে। ভাইয়ের এমন মৃত্যুতে হতবিহ্বল মাদরাসাশিক্ষক রাকিবুল। কীভাবে কী হলো পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও তার সন্দেহ ছিল কয়েকজনের ওপর। জয়দেবপুর থানায় তিনি মামলা দায়ের করেন। সরাসরি অভিযোগ চারজনের বিরুদ্ধে। অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন ওই মাদরাসার-ই প্রতিষ্ঠাতা মৌলভি আমিনুর রহমান। মৌলভি আমিনুর রহমান জয়দেবপুরের আদি বাসিন্দা নন। তার বাড়ি নোয়াখালী। তাবলিগ জামাতের একজন কর্মী। ১৯৭২ সালে বিশ্ব ইজতেমায় এসে সেখানেই থেকে যান। বিয়ে-শাদি করেন। তার দাদি শাশুড়ি রাহিমা খাতুনের নামে তিনি একটি মাদরাসা তৈরি করেন ভালোবাসার ঋণ শোধের চেষ্টায়। পাশে একটা মসজিদও বানিয়েছেন। পুলিশ অভিযুক্ত চারজনকেই গ্রেফতার করে।
বছর খানেক তদন্ত শেষে পুলিশ এজাহারের ওই চারজনের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেয়। অর্থাৎ হাফেজ রাকিবুলের দাবি সত্য। এখন বিচার হবে। আইনত ‘নারাজি’ দেওয়ার কেউ নেই। আসামিরা সবাই কারাগারে। সামনে ঘোরতর বিপদ বুঝে জেলে বসেই এ অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে তারা গাজীপুর বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ‘রিভিশন মামলা’ করেন। আদালত শুনানি শেষে জুনায়েদ হত্যা মামলা পুনঃ তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেয়। তদন্তের নির্দেশ পেয়ে পিবিআই টিম ঘটনাস্থলে যায় বার বার। খোঁজে খুনের পর কারা কারা এসেছিল, তারা কী কী দেখেছিল। শোনা যায় আখ খেতে এক জোড়া জুতা পড়ে ছিল। জুতা আর পাওয়া যায় না। ২/১ জন স্মৃতি হাতড়িয়ে বলেন জুতা জোড়া ছিল পার্শ্ববর্তী ভবানীপুর ফরিদ মার্কেটের শহীদ সানির। পিবিআই ভরসা করে গ্রামবাসীর এই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ওপর। সানি সতর্ক হয়। পুলিশ সব কিছু বাদ দিয়ে খোঁজে তার পুরনো জুতা! সে গা-ঢাকা দেয়। এবার পিবিআই অনেকটাই নিশ্চিত। তদন্ত মোড় নিতে যাচ্ছে। পিবিআই গ্রেফতার অভিযানে নামে। গ্রেফতার করে সানির ভাই বালু ফারুককে। সে এক সময় বালুর ব্যবসা করত বলে তার নাম হয়ে যায় বালু ফারুক। একে একে আটক করে আরও তিনজনকে। একজন আবার এলাকার নির্বাচিত মেম্বার শেখ মো. এমদাদুল হক। সবাই চেনে তাকে এমদাদ মেম্বার নামে। তিনি আবার সেই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মৌলভি আমিনুর রহমানের চাচা শ্বশুরের ছেলে। বালু ফারুক আদালতে স্বীকার করেন- মাদরাসা এবং মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মৌলভি আমিনুর রহমান সাহেব যতই সম্মানিত লোক হন না কেন, তিনি এলাকার স্থানীয় নন। তিনি এলাকার জামাই। ফলে প্রতিষ্ঠান দুটির নেতৃত্ব নিয়ে এমদাদ মেম্বার তার ভগ্নিপতি মৌলভি আমিনুর রহমানের সঙ্গে বিরোধ বাধিয়ে দেন। এলাকাবাসীও দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।অন্য দিকে জুনায়েদের ভাই মাদরাসার শিক্ষক রাকিবুল ইসলামের দেওয়া ‘করপোরাল পানিশমেন্ট’ (অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রদের শারীরিক শাস্তি) নিয়ে মৌলভি সাহেব সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলতেন ছাত্রদের পবিত্র কোরআন শেখাতে হবে ভালোবাসা দিয়ে। কিন্তু রাকিবুলকে মদদ দিতেন এমদাদ মেম্বার। সুতরাং রাকিবুলকে পায় কে! তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে করপোরাল পানিশমেন্ট নিয়ে নেমে পড়েন। প্রতিবাদ করায় একজন ছাত্রকে মাদরাসা থেকেও বের করে দেন রাকিবুল। পর্যায়ে এমদাদ মেম্বার মেম্বারি প্যাঁচ খেলেন। জুনায়েদ রোজ সন্ধ্যায় খাবার আনতে যায়। তার কোনো ক্ষতি হলে অবশ্যই হাফেজ রাকিবুল সন্দেহ করবেন মৌলভি আমিনুল ইসলামকে। আর ‘কাশীপুরী সাক্ষী’ (মিথ্যা সাক্ষী) তো তারা নিজেরাই আছেন। প্যাঁচ ঠিক মতো কাজ করলেই কেল্লাফতে। আমিনুল যাবে কারাগারে। আর মসজিদ ও মাদরাসা হয়ে যাবে তার (এমদাদ মেম্বার)। সে মতে এমদাদ মেম্বার ও তার অপর চাচাতো ভাই তোফাজ্জল শেখ দুই লাখ টাকার চুক্তি করে শফি সানি, সানির ভাই বালু ফারুক, এমদাদের প্রতিবেশী ওয়াদুদ মুন্সী ও নুরুল হককে। চুক্তি অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে এই চারজন জুনায়েদকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জুনায়েদ ইসলামের হাফেজ হওয়া আর হলো না। স্বপ্ন পূরণের জন্য এক কিশোর বাবা-মা ও বন্ধুদের ত্যাগ করে এসেছিল, বহুদূরের এক অজানা পরিবেশে। জুনায়েদ জানতেও পারল না তার অপরাধ কী ছিল। সূত্র : জয়দেবপুর থানা মামলা নং-৯২। তারিখ-২২/১২/২০১২ ধারা ৩০২/৩৪ দন্ডবিধি।