রবিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

আগুনে পোড়ালেও গলার ক্ষত ছিল অক্ষত

মির্জা মেহেদী তমাল

আগুনে পোড়ালেও গলার ক্ষত ছিল অক্ষত

মধ্যরাতে আগুন। ঘরের ভিতর আটকা পড়েছে তিনজন। বিল্লাল, তার স্ত্রী শাহনাজ আর তাদের দুই বছরের শিশুকন্যা মোহনা। আগুনে পুড়ছে ঘর আর তিনটি মানুষ। তাদের আর্তচিৎকার। বাঁচাও, বাঁচাও! চিৎকারে আশপাশের মানুষ ছুটে আসছে তাদের রক্ষায়। পাড়া-প্রতিবেশীরা যে যেভাবে পারছে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। কেউ ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেও পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। প্রতিবেশীদের কয়েকজন ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে। বিল্লাল উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শরীরের কিছুটা পুড়েছে। পরনের কাপড় পুড়ে কালো। শরীরেও কালি লেগে কালো হয়ে আছে। জ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু বিল্লালের স্ত্রী আর শিশুকন্যা জীবিত নেই। পুরো শরীর পুড়ে গেছে দুজনের। বিল্লালকে রাতেই নেওয়া হলো হাসপাতালে। প্রাণে রক্ষা পায় সে। জ্ঞান ফিরে আসে। জানতে চায় স্ত্রী-কন্যার কথা। সবাই নীরব। সান্ত¡না দেয়। সে মানে না কিছু। কাঁদতে থাকে। আমার শাহনাজ কোথায় গেল একা ফেলে। মোহনারে...! তার চিৎকারে চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না কেউ। পুলিশ আসে। সকালে লাশের সুরতহাল তৈরি হয়। শাহনাজের শরীর পুড়ে গেছে। লিখে যায় পুলিশ তাদের নোট বুকে। বুক পেরিয়ে গলার কাছে চোখ আটকে যায় পুলিশের এক কর্মকর্তার। কী ব্যাপার! মহিলার গলা পোড়েনি! তবে সেখানে একটা ক্ষতের চিহ্ন। গভীর ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে ধারালো কিছুর আঘাত। ভাবিয়ে তোলে পুলিশকে। তবে কী এটা নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়? অন্য কিছু আছে এতে? প্রশ্ন উঁকি দেয় পুলিশের মনে। ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার জয়নগরের ঘটনা এটি।

শাহনাজের গলার ক্ষত চিহ্ন পুলিশের তদন্তে মোড় নেয়। পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করে জানতে পারে এটি একটি হত্যাকান্ড। খুনি শনাক্ত হয়। গ্রেফতার হয় খুনি।

২০১৭ সালের রমজান মাস। বিল্লালের স্ত্রী শাহনাজ তারাবির নামাজ শেষে ভাবছিলেন রাতে কী খাবেন? ভোর রাতেই বা কী খেয়ে রোজা রাখবেন। কারণ বিল্লাল একদিন বাজার করে তো দুই দিন করে না। সব সময় স্ত্রী শাহনাজকে অভাব-অনটনেই রেখেছে। বিল্লাল ড্রাইভিং করে যা কামাই করত তার বেশির ভাগ অন্য নারীদের পেছনে খরচ করত। ওই মুহূর্তে শাহনাজ ঘরে থাকা আগের দিনের কিছু পান্তাভাত লবণ-মরিচ দিয়ে খেয়ে তার দুই বছরের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এটাই ছিল তার শেষ খাওয়া ও শেষ ঘুম! বিল্লাল রাত ১২টার দিকে ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে এসে অন্য খাটে শুয়ে অন্য নারীর সঙ্গে মোবাইলে কথা শুরু করে। টের পেয়ে স্ত্রী শাহনাজ উঠে বলেন, তুমি সারা দিন বাসায় আসনি, বাজার দেওনি, আমাদের খোঁজখবর রাখনি, এখন আবার অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলছ? এতে বিল্লাল ক্ষিপ্ত হয়ে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে শাহনাজের গলায় ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দেয় বিল্লাল। এতে শাহনাজ রক্তক্ষরণের পর মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। ওই মুহূর্তে বিল্লাল লাশটি শাহনাজের রুমে নিয়ে তার ঘুমন্ত বাচ্চা মোহনার পাশে রাখে। এরপর এ হত্যাকান্ডটি অগ্নিকান্ড হিসেবে প্রমাণ করার জন্য প্রথমে ঘর থেকে রক্ত পরিষ্কার করে। এবার বিল্লাল নিহত স্ত্রী ও জীবিত বাচ্চার গায়ের ওপর কম্বল ও বিভিন্ন কাপড়-চোপড় ছিটিয়ে দেয়। এরপর বিল্লাল ঘরে থাকা কেরোসিনের বোতল থেকে তেল ঢেলে জীবিত মোহনা ও মৃত শাহনাজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। যখন আগুন জ্বলা শুরু হলো ওই মুহূর্তে বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকে বিল্লাল। শিশু সন্তান মোহনা আগুনের তাপে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু নরপশু বিল্লাল নিজে বাঁচার জন্য নিষ্পাপ শিশু মোহনাকে উদ্ধার করেনি আগুন থেকে। স্ত্রী-সন্তানের লাশ পড়ে থাকে। বিল্লাল নিজের পরনের লুঙ্গি ও গেঞ্জি পুড়ে, শরীরে কালি লাগিয়ে রাখে। আগুন আগুন করে চিৎকার করতে থাকে। আশপাশের লোকজন এলে বিল্লাল ইচ্ছা করে বেহুঁশ হয়ে মাটিতে লুটে পড়ে। সে প্রশাসন ও বাড়ির লোকজনকে বোঝাতে চেয়েছে, ঘরে আগুন লেগে স্ত্রী-সন্তান পুড়ে গেছে, তাদের বাঁচাতে গিয়ে সে গুরুতর আহত হয়েছে। পরে স্থানীয়রা বিল্লালকে অসুস্থ ভেবে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।

খুনি বিল্লালের ধারণা ছিল, যেভাবে সে আগুন লাগিয়েছে, তাতে শাহনাজ ও মোহনা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। আর ভালোভাবে পুড়ে গেলে শাহনাজের গলার ক্ষত চিহ্ন খুঁজে পাবে না কেউ। কিন্তু বিল্লালের এ ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ হলো। আগুনে শাহনাজের শরীর পুড়লেও গলা পোড়েনি। সকালে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করার সময় পুলিশ দেখে শাহনাজের গলায় ছুরির আঘাত। এতে পুলিশ ভালোভাবে বুঝতে পারে। নিশ্চয়ই বিল্লাল এ জোড়া খুন করে বাঁচার জন্য নাটকীয়ভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ওই মুহূর্তে পুলিশ দ্রুত ভোলা সদর হাসপাতাল থেকে ঘাতক বিল্লালকে গ্রেফতার করে। এরপর স্বীকার করে তার খুন করার কাহিনি।

সর্বশেষ খবর