শিরোনাম
সোমবার, ৫ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

চার ভবনে এক লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

চার ভবনে এক লাশ

ঢাকার ফকিরাপুল কালভার্ট সড়কের উপবন হোটেলের সামনে মানুষের জটলা। পুলিশের দল পৌঁছে গেছে। লোকজনের ভিড় ঠেলে ভিতরের দিকে ঢুকছে পুলিশের দলটি। একটু এগিয়েই থমকে দাঁড়ায় পুলিশ। লাশ নয়, লাশের খন্ডিত অংশ! একটি হাত ও একটি পায়ের কাটা অংশ! ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে চলে এসেছে অ্যালিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র‌্যাব) এর সদস্যরা। এসেছে গোয়েন্দা পুলিশ ও সিআইডি। বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা তাদের নিজেদের মতো করে কাজ শুরু করছে।

খন্ডিত অংশগুলো দেখে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, হাত ও পায়ের অংশ যেহেতু পাওয়া গেছে, বাকি অংশগুলোও পাওয়া যাবে। শরীরের বাকি অংশগুলোর খোঁজ শুরু করলেন তারা। ওই স্থানটিকে কেন্দ্র ধরে চারপাশটা টার্গেট করে শুরু হলো সন্ধান। অল্প সময়ের মধ্যেই ফকিরাপুল ওয়াসা ভবনের দেওয়ালের পাশেই পাওয়া গেল খন্ডিত পা। একটু দূরেই রয়েছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সেটিও ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেরিয়ে এলো একটি হাত ও আরেক হাতের বাহু। তবে মানুষের দেহের এই খন্ডিত অংশগুলো বিকৃত। দেখেই বোঝা যাচ্ছিলা খন্ডিত অংশগুলো আগুনে পোড়া। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। পুরো এলাকাটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। গোয়েন্দারা নিশ্চিত, এটি খুনের ঘটনা। তবে খুনের বীভৎসতা দেখে তারা হতবাক। উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেরই বীভৎস খুনের তদন্তের অভিজ্ঞতা থাকলেও এটি তাদের কাছে চ’ড়ান্ত বীভৎসতা বলেই মনে হচ্ছিল। লাশ টুকড়া টুকড়া করে আগুনে পোড়ানো হয়েছে। লাশ গুমের ভয়ঙ্কর রূপ এটি। নিজেরাই বলাবলি করছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে তারা বুঝতে পারছিলেন

না, খন্ডিত অংশগুলো পুরুষ নাকি মহিলার। পুরুষ বা মহিলার-যারই হোক না কেন, একজন নাকি একাধিক ব্যক্তির খন্ডিত অংশ এসব তা তখনো তারা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। গোয়েন্দারা হাল ছাড়লেন না। পুরো এলাকায় তল্লাশি চালাচ্ছেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা লিয়াকত হোসেন (ভিন্ন নাম)। তার তদন্তের গতি প্রকৃতি একটু ভিন্ন ধরনের। সাধারণ কোনো গোয়েন্দাদের মতো নয়। তিনি তদন্ত বা অনুসন্ধান চালান নিজের মতো করে। যখন যে কাজটি করবেন, সেটি ছাড়া মাথায় অন্য কিছুই রাখেন না। ফকিরাপুলে তিনি সেই মুহূর্তে দেহের খন্ডিত অংশের খোঁজ করছিলেন। পাশাপাশি এমন  কোনো সূত্রের সন্ধান করছেন, যা দিয়ে খুনের রহস্যের জাল ভেদ করতে সহজ হয়ে যাবে।

তার চোখ ঘুরছে চারপাশে। মানব দেহের খন্ডিত অংশের খোঁজ করতে করতে ফকিরাপুল পানির ট্যাংকির পূর্ব পাশে ওয়াসার স্টোর রুম পর্যন্ত চলে গেছেন। উপবন হোটেল থেকে কিছুটা ফাঁকে সেই স্টোর রুম। স্টোর রুমের টিনের চালের ওপর চোখ আটকে যায় তার। কাপড়ের পোঁটলার মতো কিছু একটা দেখতে পেলেন। ঝুলে আছে। সন্দেহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে পোঁটলার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বিছানার চাদরের পোঁটলাটির মুখ বাঁধা। রক্তের ছোট্ট একটি দাগ তার চোখ এড়ায় না। তিনি টিনের চালে ঝটপট উঠে গেলেন। দড়ি দিয়ে বাঁধা বিছানার চাদরের পোঁটলাটি হাতে নিলেন। পোঁটলার গিঁট খুলতেই ভারি উৎকট গন্ধের একটা ঝাপটা তার নাকে এসে লাগল। তিনি ভিতরে তাকাতে পারলেন না। নিজের শরীরের ভিতরটা কেমন গুলিয়ে উঠল। নিজের মুখটা সরিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। নাক চেপে ধরে এবার চাদরের মুখ ফাঁক করে চোখ রাখলেন। কেঁপে উঠলেন ঝানু গোয়েন্দা কর্মকর্তা লিয়াকত। বীভৎস দৃশ্য! রুমাল দিয়ে নিজের নাক চেপে ধরলেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। মানব দেহের মু-ু আর হাত পা বিহীন একটি দেহ!

২০১৫ সালের ১০ মার্চে মানব দেহের খন্ডিত অংশ উদ্ধারের ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর সবার মনেই প্রশ্ন, এত পৈশাচিক হতে পারে মানুষ? দুপুর থেকে রাত অবধি গোয়েন্দাদের তল্লাশিতে সেদিন উদ্ধার হয়েছিল এক নারীর লাশের দশটি অংশ। ফকিরাপুলের চারটি ভবনের ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল নারী দেহের খন্ডিত অংশগুলো। হত্যার পর কেটে টুকরো টুকরো করে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল অপরাধীরা। তাকে হত্যার পর লাশ ১০ টুকরো করে শুধু বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়েই রাখা হয়নি। যাতে শনাক্ত করা না যায় সেজন্য তা আগুনে পোড়ানো হয়েছিল। তারপরও আধুনিক বিজ্ঞান আর তদন্তকারীদের আন্তরিকতায় সেই হতভাগ্য নারীর পরিচয় জানা যায়। গ্রেফতার হয় অপরাধীরা।

হতভাগ্য এই নারীর নাম শিমু (২০)। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় ফকিরাপুল এলাকায় থাকতেন। আর হত্যাকান্ডের আগে থেকেই তার স্বামী নাসির ছিলেন জেলে।

যেভাবে শুরু : ১০ মার্চ দুপুর সোয়া ১টার দিকে পুলিশ মতিঝিল থানার কালভার্ট রোড এলাকায় হোটেল উপবনের পাশে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি হাত ও একটি পায়ের কাটা অংশ উদ্ধার করে। এরপর পুলিশ অনুসন্ধানে নেমে একই দিন ফকিরাপুল ওয়াসা ভবনের দেওয়ালের পাশ থেকে একটি বিচ্ছিন্ন পা উদ্ধার করে। আর সেখান থেকে একটু দূরে ময়লা-আবর্জনার ভিতর থেকে একটি হাত ও একটি বাহু উদ্ধার করে। শরীরের এসব বিচ্ছিন্ন অংশ ছিল বিকৃত-পোড়া।

এসব এমনভাবে বিকৃত করা ছিল যে চেনার উপায় ছিল না। পুড়িয়ে বিকৃত করার কারণে মাথার চুল ছিল না। পুলিশ প্রথমে শরীরের সব অংশ পায়নি। তাই আরও অনুসন্ধান চালিয়ে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ১৯৩/২ ফকিরাপুলের আহসান মঞ্জিলের সাত তলার সিঁড়ির শেষ প্রান্তে আগুনে পোড়া মাথার আংশিক খুলি উদ্ধার করে। আর তা ছিল ছাই-কালি মাখানো।

পুলিশ শরীরের বিচ্ছিন্ন বিকৃত অংশগুলো এক করে মানুষের অবয়ব পায়। এরপর তা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়। সেখানে ময়নাতদন্ত এবং ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে উদ্ধার করা শরীরের অঙ্গগুলো একই ব্যক্তির এবং তিনি একজন নারী। তার বয়সও জানা যায় আনুমানিক ২০ বছর। তবে তখনো তার নাম-পরিচয় জানা যায়নি। তদন্ত চলাকালে পুলিশ আরও অনুসন্ধান চালিয়ে ফকিরাপুলের ১৯৩/২ নম্বর বাড়ির দেওয়ালে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ দেখতে পায়। সাত তলা এই বাড়ির সিঁড়ির শেষ প্রান্ত থেকেই এর আগে আংশিক মাথা উদ্ধার করা হয়। আর সেই রক্তের দাগ ধরে বাসার ছাদে উঠে পায় রক্তমাখা ছুরি, কেরোসিন তেলের বোতল এবং রক্ত মাখা শার্ট-প্যান্ট। পরে জানা যায় প্যান্ট-শার্ট যারা হত্যা করেছে তাদের। তবে পুলিশকে ছাদে উঠতে হয়েছে ছাদের দরজার তালা ভেঙে। বাড়ির মালিক মোবারক হোসেন মন্টিকে তখন পাওয়া যায়নি। চাবি নিয়ে আগেই সে লাপাত্তা। পুলিশ বাড়ির চার তলায় বসবাসরত মাদক ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন মন্টির স্ত্রীকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করে। আর জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় এই নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা। জানা যায় হতভাগ্য নারীর নাম, পরিচয় ও ঠিকানা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মাদক ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন মন্টিসহ মোট ছয়জনকে আটক করে। তাদের মধ্যে চারজন আদালতে হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। তারা জানিয়েছে ৯ মার্চ গভীর রাতে মন্টির বাসার ছাদে বসে শিমুকে জবাই করা হয়। এর পর তাকে কেটে মোট ১০ টুকরা করা হয়। শরীরের বিভিন্ন অংশ কেরোসিন তেল দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে বিকৃত করা হয়। আর সেই বিকৃত অংশগুলো নানা জায়গায় ফেলে দেওয়া হয় যাতে তাকে আর শনাক্ত করা না যায়। হত্যাকান্ডের আগে শিমুকে ইয়াবা সেবন করানো হয়। এরপর তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মুখে কাগজ গুঁজে স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে দেওয়া হয় যাতে চিৎকার করতে না পারে। লাশ টুকরা টুকরা করা হয় খাইট্টার ওপর রেখে কুপিয়ে কুপিয়ে। মন্টির বাসার ছাদ থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহিত ছুরি এবং লাশ টুকরো করার দাসহ আরও অনেক আলামত উদ্ধার করে পুলিশ।

গোয়েন্দারা জানতে পারে, শিমুর স্বামী নাসিরও একজন মাদক ব্যবসায়ী। সে এই আটক আসামিদের সঙ্গেই মাদক ব্যবসা করত। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হলে হত্যাকান্ডের ৪/৫ দিন আগে তারা ইয়াবাসহ ধরিয়ে দিলে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে এক বছরের কারাদন্ড দেয়। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিমু মাদক ব্যবসায়ী মন্টিসহ অন্যদের মাদক ব্যবসার কথা পুলিশকে জানিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। আর এ কারণেই শিমুর মুখ বন্ধ করতে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর চেষ্টা করা হয় হত্যাকান্ডের নিশানা মুছে ফেলতে। তিনি আরও জানান, শিমু তাদের পরিচিত এবং তারা শিমুকে ঘটনার রাতে ধরে নিয়ে বাসার ছাদে হত্যা করে। এর আগে তারা শিমুকে পালাক্রমে সবাই ধর্ষণ করে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর