রবিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

পশ্চিমবঙ্গের ভোটে ব্যাপক সহিংসতা

পাঁচজন নিহত, বিজেপি হারছে বলে গুলি করে মানুষ মারছে : মমতা

কলকাতা প্রতিনিধি

পশ্চিমবঙ্গের ভোটে ব্যাপক সহিংসতা

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান -বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রথম তিন দফার ভোট মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হলেও পশ্চিমবঙ্গে চলমান বিধানসভা নির্বাচনের চতুর্থ দফার ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে গতকাল সহিংসতার বলি হয়েছেন পাঁচজন, আহত হয়েছেন আরও চারজন। এই হতাহতের জন্য তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে দায়ী করে বলেছেন, ওনারা হেরে যাচ্ছেন বলে গুলি করে মানুষ মারছেন। তিনি এ জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি করেছেন।

এই দফায় পাঁচ জেলার ৪৪ আসনে ভোট নেওয়া হয়। এর মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশপরগনা জেলায় ১১টি, হুগলি জেলায় ১০টি, হাওড়ায় ৯টি এবং উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলায় ৯টি ও কোচবিহার জেলার ৫টি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হয়।  কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ভোট নেওয়া হলেও বেলা বাড়তেই একাধিক জায়গায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যায় উত্তরবঙ্গে কোচবিহার জেলা। কার্যত রক্তবন্যা বয়ে যায় এই জেলার শীতলকুচি এলাকায়।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, সকাল ৮টা নাগাদ প্রথম সহিংসতার ঘটনা ঘটে। জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে এসে আনন্দ বর্মণ নামে ১৮ বছরের এক তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়। গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূল আশ্রিত দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, শীতলকুচির পাগলাপীর এলাকায় একটি বুথে ভোটের লাইনে দাঁড়ানো ওই তরুণের পিঠে গুলি লাগে। এই মৃত্যুর সত্যতা স্বীকার করে জেলার পুলিশ সুপার দেবাশিস ধর জানান, ‘এ ঘটনায় আমরা দুজনকে আটক করেছি।’ এ ঘটনার পরই মৃতের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। মৃতের বাবার দাবি, তার ছেলে বিজেপি সমর্থক। অন্যদিকে তৃণমূলের দাবি মৃত যুবক তাদের দলের সমর্থক। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই শীতলকুচিতে ফের গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। শীতলকুচি বিধানসভা কেন্দ্রের মাথাভাঙার জোরপাটকি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫/১২৬ নম্বর বুথের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে আরও চারজনের মৃত্যু হয়, আহত হয় আরও চারজন। তাদের মাথাভাঙা মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তৃণমূলের দাবি নিহত চারজনই তাদের দলের সমর্থক। এ ঘটনায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার পরই অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট চেয়ে পাঠায় নির্বাচন কমিশন। এরপর রাজ্যের বিশেষ নির্বাচনী পুলিশ পর্যবেক্ষক বিবেক দুবের তরফে কমিশনের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করা হয় তাতে বলা হয়, এদিন সকালে ভোট গ্রহণ পর্ব শুরু হওয়ার কিছু পরেই শীতলকুচির জোড়াপাটকির ওই বুথে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। একসময় ওই বুথটি ঘিরে ফেলে বেশ কিছু মানুষ। এর মধ্যে কয়েকজন মানুষ ওই বুথে প্রহরারত কেন্দ্রীয় বাহিনীর অস্ত্র ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। আর তখনই আত্মরক্ষার্থে বাধ্য হয়েই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে গুলি চালাতে হয়। আর এই মৃত্যুর পরই সরগরম হয়ে উঠেছে রাজ্য-রাজনীতি। ওই ঘটনার পরই ১২৬ নম্বর বুথটিতে ভোট গ্রহণ স্থগিতের নির্দেশ দেয় কমিশন।

শীতলকুচিতে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকেই দায়ী করেন রাজ্যটির ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান মমতা ব্যানার্জি। এদিন উত্তর চব্বিশপরগনা জেলার বনগাঁ ও হালিশহরে দুটি পৃথক নির্বাচনী জনসভা থেকে মমতা বলেন, ‘আজ কোচবিহারে দিল্লির পুলিশ আমার পাঁচ ভাইকে মেরে দিয়েছে, খুন করেছে। আমি তার নিন্দা করছি। সকালে আরও একজনকে মেরেছিল। আমি বলছি এর জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীই দায়ী। আমি তার পদত্যাগ দাবি করছি।’ মমতা আরও বলেন, ‘অমিত শাহ চক্রান্তকারী। তার জন্যই মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমি অনেক দিন ধরেই বলছি যে, কেন্দ্রীয় বাহিনী চক্রান্ত করছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই, কিন্তু গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, নারীদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। বলা হচ্ছে বিজেপিকে ভোট দাও। আর ভোটের লাইনেই গুলি চালিয়ে দিল? এত বড় সাহস কে দিল?’ আজ রবিবার কোচবিহারের সেই অশান্ত জায়গা পরিদর্শনে যাবেন বলেও এদিন জানান মমতা।

পরে বিকালে শিলিগুড়িতে একটি সংবাদ সম্মেলন করে মমতা বলেন, ‘বাংলা দখলের জন্য সহিংসতার রাজনীতি করছে বিজেপি। অমিত শাহর নির্দেশেই কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালিয়েছে।’ তার বক্তব্য- ‘যখন বিজেপি গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটে জিততে পারে না, তখন এসব করে। অন্যায় করে লোক মেরে বলছে আমি আত্মরক্ষার জন্য করেছি।’

শীতলকুচির এ ঘটনায় তৃণমূলের নারী সাংসদ মহুয়া মৈত্র টুইট করে লিখেছেন- ‘নির্বাচন কমিশন কেন্দ্র সরকারের হাতে পুতুলে পরিণত হয়েছে। এই মৃত্যুর জন্য কমিশনই দায়ী।’

অন্যদিকে শিলিগুড়িতে বিজেপির এক জনসভায় উপস্থিত হয়ে শীতলকুচিতে গুলি চলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ ঘটনায় মমতা ব্যানার্র্জিকে ইঙ্গিত করে মোদি বলেন, ‘কোচবিহারে যা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখের। যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মৃত্যুতে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। বিজেপির সমর্থন দেখে দিদি ও তার গুন্ডারা ভয় পেয়ে গেছে। পরাজয় আসন্ন বুঝেই দিদি এতটা নিচে নেমেছে। কিন্তু দিদি ও তার দলের কর্মী গুন্ডাদের বলে দিতে চাই যে, এই জিনিস আর চলতে পারে না।’ দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনের প্রতিও আর্জি জানান মোদি।

আবার এই মৃত্যুর পেছনে বাংলার সংকীর্ণ রাজনীতিকেই দায়ী করেছে কংগ্রেস। দলের লোকসভার সংসদ সদস্য অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘এটা নির্বাচন কমিশনের তৎপরতার অভাব। কমিশন বাংলার মাটির কথা বুঝতেই পারছে না। শান্তিশৃঙ্খলাভাবে ভোট করানোর জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করার দরকার নির্বাচন কমিশন তাতে একদম ব্যর্থ।’

 তবে কেবল কোচবিহারই নয়, রাজ্যের হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে হামলার শিকার হন চুঁচুড়ার বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়। ব্যান্ডেলের ৬৬ নম্বর বুথে রিগিংয়ের অভিযোগ পেয়ে সেখানে গেলে তাকে হেনস্থা করা হয়, তার গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। কলকাতার কসবার ধানকল এলাকায় বেশ কয়েকটি বাড়িতে ঢুকে ভোটার কার্ড কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিজেপির অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ খবর