মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ট্রাইব্যুনাল বাড়লেও কমছে না নারী-শিশু মামলা

আরাফাত মুন্না

ট্রাইব্যুনাল বাড়লেও কমছে না নারী-শিশু মামলা

২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর। পার্বতীপুর উপজেলার জমিরহাট তকেয়াপাড়ার পাঁচ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ঘটনার দুই দিন পর ২০ অক্টোবর মেয়েটির বাবা দিনাজপুরের পার্বতীপুর মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি সাইফুল ইসলাম ও আফজাল হোসেন কবিরাজ। মামলার চারদিন পর দিনাজপুর শহর থেকে সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে আফজালকেও গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি চার্জশিট দেয় পুলিশ। মামলাটি এখনো দিনাজপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনে বিচার শেষ করার বিধান থাকলেও প্রায় চার বছর ধরে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়েই আছে মামলাটি। শুধু এ মামলাই নয়, সারা দেশে ১০১টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে এমন ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মামলা। বিশাল এ মামলার জট কমাতে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করা হলেও কমেনি মামলার সংখ্যা। ট্রাইব্যুনালগুলোয় নিয়মিতভাবেই বাড়ছে বিচারাধীন মামলা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন অনেক বেড়েছে। এ কারণে বাড়ছে মামলাও। পাশাপাশি মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা কম রয়েছে। এ ছাড়া সময়মতো সাক্ষী হাজির না হওয়া, মামলার তদন্ত যথাসময়ে শেষ না করা, মামলার পক্ষগুলোর সময় ক্ষেপণসহ নানা কারণে মামলার বিচার বিলম্বিত হয়। আইনজ্ঞরা বলেন, আইনের বিধান অনুযায়ী এসব মামলার বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮০ দিনে (ছয় মাস) শেষ করার কথা। মামলার তদন্ত শেষ করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে। ওই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে ট্রাইব্যুনালকে কারণ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করে একটি অনুলিপি সরকারকে পাঠানোর কথা। তদন্তের ক্ষেত্রেও একই ধরনের বিধান আছে। কিন্তু আইনের বিধান প্রতিপালিত হচ্ছে না। মামলাও দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এতেই বেড়ে যেতে থাকে মামলার জট।

দেশে ধর্ষণ, যৌন বা শারীরিক নির্যাতন-হয়রানিসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের সব ধরনের অপরাধের বিচারে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করে সরকার। এ আইনের অধীনে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ৪৬ জেলায় ৫৪টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ছিল। যেসব জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ছিল না সেগুলোয় সংশ্লিষ্ট জেলা ও দায়রা জজ ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব পালন করতেন। এতে বিচার বিলম্বিত হতো। আর বিচার বিলম্ব হলেই বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তিও বাড়ে। বিষয়টি বিবেচনা করে ২০১৮ সালে নতুন ১২ জেলায় ১২টিসহ মোট ৪১টি নতুন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করে সরকার। এরপর গত বছর দেশের বাকি ছয় জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হয়। জেলাগুলো হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইল, রাঙামাটি, বান্দরবান, ঝালকাঠি ও পঞ্চগড়।

সর্বশেষ ১৬ মার্চ আইন মন্ত্রণালয় থেকে ২২টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ স্থাপিত বান্দরবান, রাঙামাটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঝালকাঠি জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেও বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। এখন দেশের ৬৪ জেলাতেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল হয়েছে। মোট ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০১টিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে করা বিচারাধীন মামলা ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার। কিন্তু বর্তমানে এ সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি। সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এসব মামলার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। এ ছাড়া ১ হাজারের ওপর মামলার বিচার বন্ধ রয়েছে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলার জট কমাতে হলে বিচার বিভাগে এখনই অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় মামলার এ বিশাল স্তূপ কমানো সম্ভব হবে না। এ ছাড়া মুলতবি ছাড়া বিচারকাজ শেষ করা গেলেই মামলার জট কমানো সম্ভব হবে।’ জানতে চাইলে আইনজীবী ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো অন্য মামলার তুলনায় একটু ভিন্ন। তাই এ মামলাগুলোয় গুরুত্বও বেশি দিতে হয়। বিচারক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব।’

সর্বশেষ খবর